আলোর মনি ডটকম রিপোর্ট: দেশের উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী লালমনিরহাট জেলার গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তভিতের উপর দাঁড়িয়ে গেছে। সর্বত্র এখন উন্নয়নের ছোঁয়া। বিশেষ করে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমুল পরির্বতন ঘটেছে। তিস্তা ও ধরলা নদীর উপর ২টি বড় বড় সেতু নির্মাণ হয়েছে। রেলওয়ে লাইন মেরামত ও সংস্কার হয়েছে। যাত্রীবাহী ট্রেনের সংখ্যাও বেড়েছে। প্রতিটি গ্রামের সাথে এখন সড়ক পথে যোগাযোগ রয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতি এখন চাঙ্গা ভাব সৃষ্টি হয়েছে। সমৃদ্ধির পথে হাটছে গ্রামীণ কৃষিজ অর্থনীতি। মঙ্গা শব্দ এখন ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। এক সময় ছিল আশ্বিণ কার্তিক মাস এলেই উত্তরের জেলাগুলোতে অভাব বা মঙ্গা দেখা দিতো। এখন সেই অবস্থা আর নেই। বর্তমান সরকার নানা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। গ্রামের মানুষ সেই সব সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুফল পেতে শুরু করেছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ফলে মঙ্গা উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো থেকে বিদায় নিয়েছে। নতুন প্রজন্মের কাছে মঙ্গা শব্দটি অপরিচিত একটি শব্দ। কয়েক বছর আগে আশ্বিণ কার্তিক মাস এলেই গ্রামে গ্রামে হা হা কার পড়ে যেত। দিনমজুর কৃষি শ্রমজীবি মানুষের কাছে কোন কাজ থাকতো না। এখন সেই অবস্থা নেই। এখন সারা বছর ধরেই গ্রামে কৃষি কাজ চলে। বরং উল্টোটা হয়েছে। কৃষি শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না।
বিগত কয়েক বছর আগে উত্তরের লালমনিরহাট জেলায় আশ্বিণ কার্তিক মাসে মৌসুমী কৃষি কাজের অভাবে মঙ্গা বা অভাব দেখা দিত। মানুষের হাতে কাজ ছিল না। তাই শ্রমিজীবি মানুষ জীবন বাঁচাতে খাদ্য সামগ্রী ক্রয় করতে পারতো না। মানুষ কচু, ঘেচু, কলার গাছের থোর খেয়ে জীবন বাঁচাতো। গ্রামে গ্রামে অলস সময় কাঁটাতো শ্রমজীবি মানুষ। এখন সেই চিত্র নেই। এখন গ্রামে কৃষিজ শ্রমিক বেকার মানুষের সংখ্যা কমে এসছে। আশ্বিণ কার্তিক মাসে গ্রামে শীতের সব্জি চাষের কাজ শুরু হয়। শুরু হয় ধান কাঁটার কাজ। এখন কৃষিজ শ্রমিক দিনমজুরিতে কাজ করতে চায় না। তারা ঠিকা পদ্ধতিতে কাজ করতে বেশি আগ্রহী। ঠিকা পদ্ধতিতে একজন শ্রমিক দিনে ৬/৭শত টাকা আয় করে। যা দিয়ে তার দৈনন্দিনের চাহিদা মিঠে কিছু অর্থ জমাতে পারে।
আশ্বিণ কার্তিক মাসে গ্রামে ঘুরে দেখা যায় উত্তরের জেলার প্রতিটি গ্রাম যেন প্রাণচাঞ্চল্যতা ফিরে পেয়েছে। বিস্তৃণ ফসলের পাকা ধানের মাঠে কৃষি শ্রমিক কাজে ব্যস্ত সময় পাড় করছে। শীতের সব্জি ক্ষেতে কাজ করছে শ্রমিক। এমন কি উল্লেখযোগ্য নারী কৃষি শ্রমিকরাও পুরুষের সাথে সমান তাল মিলিয়ে মাঠে কাজ করছে। গ্রামের প্রতিটি পরিবারের কোন একজন সদস্য ঢাকা, কমিল্লা, চট্টগ্রাম ও বগুড়াসহ দেশের নানা অঞ্চলে শিল্প কারখানায় অথবা গার্মেন্টসে কাজ করছে। এভাবেই প্রতিটি পরিবার এখন আর্থিক দিক দিয়ে স্বচ্ছলতা ফিরে পেয়েছে। গ্রামে গ্রামে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। মানুষ এখন শুধু খাদ্য দ্রব্য কিনে না। পরিবারের জন্য ফলমুল ও প্রসাধনী সামগ্রীয় কিনছে। চাহিদা থাকায় ব্যবসায়ীরা গ্রামের সাধারণ মানুষ এখন হাতের কাছে প্রসাধনী সামগ্রী ও ফলমুল নিয়ে গেছে। ৮০দশকে একজন অসুস্থ্য মানুষের জন্য ফল কিনতে হলে রংপুরে যেতে হত। এখন ফলমুল প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামের হাট বাজারে অথবা গ্রামের রাস্তার মোড়ে দোকানে পাওয়া যাচ্ছে।
গ্রামীণ জনপদের আর্থিক স্বচ্ছলাতার কারণে গ্রামীণ অর্থনীতি এখন যেকোন সময়ের চেয়ে ভাল অবস্থানে রয়েছে। গ্রামে আগে কুড়ে ঘর ছিল। এখন কুড়ে ঘর দেখতে পাওয়া যায় না। কুড়ে ঘর দেখতে হলে জাদুঘরে যেতে হবে। গ্রামের দরিদ্র মানুষও এখন টিনের ঘরে বসবাস করে। খড়ের চালের ঘর এখন কোন গ্রামে দেখা যায় না। গরীব মানুষেরা এখন টিনে চালা ও টিনের বেড়া দেয়া ঘরে বসবাস করে। এছাড়াও আগে গ্রামের মানুষ খোলা স্থানে ঝোপঝাড়ে পায়খানা করতো। এখন সে অবস্থা নেই। গরীব-ধনী প্রতিটি বাড়িতে স্যানেটারী পায়খানা দেখা যায়। কয়েক বছর আগে গ্রামের বাড়িগুলোতে বাওটাটির বেড়া ছিল না। বাড়ির ছিল না কোন পর্দা ব্যবস্থা । এখন সেই চিত্র নেই। গ্রামের প্রতিটি বাড়ির বাওটাটির বেড়া (বাড়ির বাহিরে নিরাপত্তা ও পর্দা প্রথার বেড়া) রয়েছে। বাড়ির চারিদিকে পর্দা ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিটি বাড়ি সুরক্ষিত। গ্রামগুলোর চিত্র দেখলে মন ছুড়িয়ে যায়। লালমনিরহাট জেলায় ৫৯টি ছিটমহল রয়েছে। ২০১৫ সালে ৩১ জুলাই মধ্য রাতে ভারত বাংলাদেশ ছিটমহল চুক্তির বিনিময়ে বাংলাদেশের হয়েছে। এসব বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোর ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোও মূলধারা গ্রামীণ অর্থনীতির সাথে মানিয়ে নিয়েছে। বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতেও দারিদ্রতা হ্রাস পেয়েছে। অর্থনৈতি ও সামাজিক বৈষম্য হ্রাস পেয়েছে।
উত্তরের জেলাগুলোতে গ্রামে দারিদ্রতার হার কমেছে। হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। ধনী ও গরীবের মধ্যে অর্থনৈতিক ব্যবধান কমে আসছে। কৃষি শ্রমজীবি ও কৃষক পরিবারের মধ্যে বৈষম্য কমতে শুরু করেছে। তবে এক শ্রেণির রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত সুবিধাবাদি ধনীক শ্রেণির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিটি গ্রামে এখন পাঁকা ও কাঁচা রাস্তা রয়েছে। রয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। রয়েছে নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়। প্রতিটি গ্রামের ৬হাজার মানুষকে নিয়ে গড়ে উঠেছে কমিউনিটি ক্লিনিক। গ্রামে গ্রামে পৌচ্ছে যাচ্ছে হাই স্পিটের ইন্টার নেট সেবা। প্রায় প্রতিটি গ্রামে পৌচ্ছে গেছে বিদ্যুৎ। কোন কোন গ্রামের রাস্তাঘাট ও হাট-বাজারে শহরের মতো সৌরচালিত স্ট্রীটলাইট সন্ধ্যার আধার নামার পর পরেই জ্বলে উঠে।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইট হতে জানা গেছে, এ জেলায় মোট গ্রাম ৪৭৮টি, আদর্শ গ্রাম ৫৬টি, দারিদ্রতার হার ২১দশমিক ৮, হতদারিদ্রতার হার ১১দশমিক ৩, আশ্রয়ণ প্রকল্প ৩৮টি, আবাসন ১৭টি, হাট-বাজার ১০১টি, কুটির শিল্প ৭হাজার ৫শত ৮২টি, ক্ষুদ্র শিল্প ৬৪২টি, গবাদি পশুর খামার ৩হাজর ২শত ৪৫টি, মুরগির খামার ৭১১টি, দুগ্ধ খামার ৭২৬টি, পাঁকা রাস্তা ৭৮৫ দশমিক ৮৪কিঃমিঃ, কাঁচা রাস্তা ১৫৭১ দশমিক ৭০কিঃমিঃ ও এইচবিবি রাস্তা ১৪দশমিক ৪০কিঃমিঃ। গ্রামীণ জনপদে সর্বত্র উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ ব্যক্তিগত উদ্যোগে ও চেষ্ঠায় উন্নয়ন করেছে। দেশের মানুষের বর্তমান মাথাপিছু আয় ১হাজার ১৯মার্কিন ডলার। দেশের জিডিপি এখন ৮দশমিক ১৩তে পৌচ্ছে গেছে। তবে এখন উত্তরের জেলাগুলোর চরাঞ্চলের মানুষের উন্নয়ন সেভাবে ঘটেনি। জেলায় ৬টি নদী রয়েছে। এই নদীর চরাঞ্চলের উন্নয়ন ঘটাতে হবে।
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : অধ্যক্ষ মোঃ রবিউল ইসলাম মানিক
সম্পাদক : মোঃ মাসুদ রানা রাশেদ
প্রকাশক : মোঃ রমজান আলী
নির্বাহী সম্পাদক : মোঃ হেলাল হোসেন কবির
Copyright © 2024 আলোর মনি. All rights reserved.