আবহমান গ্রাম বাংলার সুপরিচিত একটি জলজ উদ্ভিদের নাম “কচুরিপানা”। লালমনিরহাট জেলাসহ বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি এলাকায় হাওর-বাঁওড়-খাল-বিল আর শস্য-শ্যামল সবুজে ভরপুর ছোট বড় হাওর, বিল, ঝিল ও বাড়ির পাশের ডোবায় এখন ফুটেছে দৃষ্টিনন্দন কচুরিপানা ফুল দেখতে পাওয়া যায়। এটি একটি বহু-বর্ষজীবী ভাসমান জলজ উদ্ভিদ। এর বৈজ্ঞানিক নাম Eichhornia crassipes।
বাংলাদেশের বিল-ঝিল-হাওর-বাঁওড়ে বিভিন্ন জাতের বিভিন্ন রঙের ফুল ফোটে বিভিন্ন ঋতুতে। এসবের মধ্যে কিছু আছে যা আমাদের কাছে সৌন্দর্য বর্ধক, দৃষ্টিনন্দন, উপকারী কচুরিপানা বিভিন্ন নদী-নালা-খাল বিল, পুকুর, ডোবায় ও জলাশয়ে ফুটে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দেয় এবং জৈব সার তৈরিতে সাহায্য করে। কচুরিপানা ও তার ফুল জনপ্রিয় না হলেও বিভিন্ন সময়ে মাছ, গবাদিপশুর খাদ্য ও জৈব সার হিসেবে এর ব্যবহার হয়ে থাকে।
লালমনিরহাট জেলার ৫টি (লালমনিরহাট সদর, আদিতমারী, কালীগঞ্জ, হাতীবান্ধা, পাটগ্রাম) উপজেলার ৪৫টি ইউনিয়ন ও ২টি (লালমনিরহাট, পাটগ্রাম) পৌরসভার নদী-নালা, খাল-বিলে কচুরিপানার দেখতে পাওয়া যায়।
জানা যায়, কচুরিপানা হলো ভাসমান এমন একটি প্রাকৃতিক জলজ উদ্ভিদ যার উৎপত্তিস্থল ব্রাজিল (আমাজন), এর ৭টি প্রজাতি রয়েছে। গ্রীষ্ম-লীয় এলাকায় এটি খুব দ্রুত বংশবিস্তার করে, এমনকি ৬দিনেরও কম সময়ে সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। দেখার দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে কচুরি ফুলের মতো এত চমৎকার ফুল খুব কম আছে। পরিমাণগত দিক দিয়েও এর মতো এত ব্যাপক বিস্তৃত ফুল খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়- “দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দু’পা ফেলিয়া।” সত্যিকার অর্থেই যেখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এক আগাছা উদ্ভিদ যার কিনা উপকারের চেয়েও অপকারী দিক কোনো অংশেই কম না, এমন এক অবহেলিত উদ্ভিদে এত নয়নাভিরাম, মনোমুগ্ধকর, চিত্তাকর্ষক ফুল যা প্রকৃতি প্রেমীদের বিমুগ্ধ না করে পারে না।
আমাদের দেশের কৃষকেরা আলু, পটোলসহ বিভিন্ন সবজি চাষে কচুরিপানার সার ব্যবহার করে থাকেন। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা জলাশয় থেকে কচুরিপানার ফুল উঠিয়ে খেলা করে। মেয়েরা খোপায় বাঁধে। কচুরিপানার ৭টি প্রজাতি আছে। এর পুরু চকচকে এবং ডিম্বাকৃতির পাতা পানির উপরি ভাগে প্রায় ১মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। এর কাণ্ড দীর্ঘ, বহু বিভক্তি মূল বের হয়। যার রং বেগুনি, সাদা, গোলাপি ও হলুদ। একটি পুষ্প থেকে ৯টি থেকে ১৫টি আকর্ষণীয় পাপড়ির ফুলের থোকা বের হয়। কচুরিপানা খুব দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করে। এটি প্রচুর পরিমাণে বীজ তৈরি করে। ৩০বছর পরও অঙ্কুরোদগম ঘটাতে পারে। কৃষি বর্জ্য থেকে জৈব সার তৈরি করতে সময় লাগে ৭০দিন; কিন্তু কচুরিপানা থেকে সময় লাগে ৫৫দিন। কচুরিপানাতে বড় বড় কুঠুরি থাকে যা পানিতে পরিপূর্ণ সামান্য আগাতে সহজে ভেঙে যায়।
আরও জানা যায়, অর্কিড সাদৃশ্য ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে স্কনক নামে এক ব্রাজিলিয়ন পর্যটক ১৮শ’ শতাব্দীতে বাংলায় নিয়ে আসেন কচুরিপানা। এরপর থেকেই বাংলার প্রায় প্রতিটি হাওর-বাঁওড়-জলাশয়ে ভরে যায়। কচুরিপানা দেখতে গাঢ় সবুজ হলেও এর ফুলগুলো সাদা পাপড়ির মধ্যে বেগুনি ছোপযুক্ত এবং মাঝখানে হলুদ ফোঁটা থাকে। সাদা এবং বেগুনি রং-এর মিশেলে এক অন্যরকম আবহ তৈরি করে। সাদা পাপড়ির স্থলে কোথাও হালকা আকাশি পাপড়িও দেখতে পাওয়া যায়।
পুরোপুরি ফুল ফোটার আগে একে দেখতে অনেকটা নলাকার দেখায়। পাপড়িগুলোর মাঝখানে পুংকেশর দেখতে পাওয়া যায়। প্রতিটি ফুলে ছয়টি করে পাপড়ি দেখা যায়। এলাকাভিত্তিক অনেকে একে একেক নামে চিনে থাকে। বাংলাদেশে প্রায় সাত প্রজাতির কচুরি দেখতে পাওয়া যায়। প্রায় সারা বছরই কচুরি ফুল ফুটতে দেখা যায়। কচুরি ফুলের মুগ্ধতায় আমাদের মধ্যে প্রকৃতি প্রেম জাগ্রত হোক।
প্রকৃতি প্রেমী হেলাল হোসেন কবির, এস এম হাসান আলী ও রশিদুল ইসলাম রিপন বলেন, রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে এই নয়নাভিরাম কচুরিপানা ফুল ফোটার দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। এ দৃশ্য উপভোগ করার মতো। অনেকেই ফুলের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি ও সেলফি তুলে রাখেন।
ফুলগাছ ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম খন্দকার বলেন, কচুরিপানা মাছ, গবাদিপশুর খাদ্য ও জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা যায়। কৃষি বর্জ্য থেকে জৈব সার তৈরি করতে সময় লাগে ৭০দিন; কিন্তু কচুরিপানা থেকে সময় লাগে মাত্র ৫৫দিন।