মোঃ মাসুদ রানা রাশেদ: বাংলার ইতিহাসে বাঙালির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য একটি গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা হলো একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে আমরা এই মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হয়েছি। এখন সেই মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের মাস মার্চ। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের সর্বস্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে শরিক হয়েছিলেন।
ডিসেম্বর ও মার্চ মাস এলেই আমরা সবাই লালমনিরহাট মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিসৌধ, শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম ফলক, রেলওয়ে গণকবরে শহীদদের স্মরণে পুষ্পস্তবক অর্পণ করি। সবাই একত্রিত হয়ে শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই, কিন্তু অনেকেই আমরা জানি না ১৯৭১-এর মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বিহারি অবাঙ্গালির হাতে প্রাণ দিয়েছিলেন লালমনিরহাটের থানাপাড়ার একই পরিবারের ৬ (ছয়) জন। এটা অবশ্যই আমাদের সবার জানার দরকার রয়েছে। আমাদের বাঙালির ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
প্রথমেই উল্লেখ করতে হয়, মহান মুক্তিযুদ্ধে সে সময় কতজন শহীদ হয়েছিলেন তা সঠিকভাবে বলা আজ কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়। ১৯৭১ সালের মে মাসের পহেলা সপ্তাহে বিহারি অবাঙ্গালির হাতে শহীদ হন লালমনিরহাটের থানাপাড়ার আওয়ামী লীগ কর্মী আজহার আলী-এঁর মা ছালেমুন নেছা, স্ত্রী সিরাজুন নাহার, কন্যা ছায়া, বুলু, মিনু ও কাজের ছেলে (রাখাল)।
৫জন শহীদের নাম, পরিচয়, ঠিকানা ইত্যাদির সন্ধান পাওয়া গেলেও কিন্তু একজনের পাওয়া যায়নি। তবে ৫জনের মৃত্যু এই তথ্যটি বিশেষভাবে গুরুত্ব বহন করে। মহান মুক্তিযুদ্ধে সেই ৫জন শহীদের পরিচিতি এখানে তুলে ধরা হলো-
(১) মা ছালেমুন নেছা, (২) স্ত্রী সিরাজুন নাহার, (২) কন্যা ছায়া, (৪) বুলু, (৫) মিনু।
শহীদ হয়েছেন ১৯৭১ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে
পরিচয় : আওয়ামী লীগ কর্মী আজহার আলী-এঁর মা, স্ত্রী, কন্যা।
ঠিকানা : থানাপাড়া, লালমনিরহাট।
প্রাণে বেঁচে গেলেন যাঁরা: আজহার আলী, কন্যা খালেদা খানম, মনোয়ারা খানম আলো, জাহানারা বেগম দুলু ও একমাত্র পুত্র নুর ইসলাম।
বেঁচে থাকার গল্প: যেহেতু আজহার আলী একজন সক্রিয় আওয়ামী লীগ কর্মী। তাঁর প্রতিবেশী জনৈক এক বিহারী হফেজ কামরুদ্দীন (বিহারী লিডার) তাহাকে সর্তক করে বলেন যে, তুমি তো আওয়ামী লীগ করো তোমার কিছু হবে না। তোমার ছেলেটিকে (নুর ইসলাম) কে রাজাকারে ভর্তি করে দাও এবং উল্লেখিত মেয়েদেরকে ভারতে পাঠিয়ে দাও।
উল্লেখিত ঘটনা শোনার পর আজহার আলী লালমনিরহাটে থাকা নিরাপদ বোধ করলেন না। তাই তিনি নিজে ৩মেয়ে ও ১ছেলেকে নিয়ে ১৯৭১ সালের এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে ভারতে চলে যান। সেখানে শরনার্থী শিবিরে ৯মাস অবস্থানের করে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিজ বাড়ীতে ফিরত আসেন। ইতিমধ্যে তাঁর রেখে যাওয়া বৃদ্ধ মা, স্ত্রী, ৩ (তিন) নাবালক কন্যা ও বাড়ীর কাজের ছেলে (রাখাল) কে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে জবাই করে হত্যা করা হয়।
তাঁর ধারণা ছিলো যে, বৃদ্ধ মা, স্ত্রী ও নাবালক শিশুদেরকে কেউ হত্যা করবে না। কিন্তু তাঁর ধারণা সবকিছু শেষ হয়ে যায় উক্ত হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে।
জীবিতরা কে কোথায়: কন্যা খালেদা খানমঃ ছাত্র জীবনে কৃতিত্বের সাথে এইচএসসিতে লালমনিরহাট কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে ১৯৬৮ সালে তধ্যানিত্বন রাজশাহী বোর্ডে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কৃতিত্বের সাথে অনার্স ও মাস্টার্স পাশ করে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা করেন। বর্তমানে তিনি অবসর প্রাপ্ত। ঢাকায় স্বপরিবারের অবস্থান করছেন।
কন্যা মনোয়ারা খানম আলোঃ তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করে ঢাকার একটি কলেজে শিক্ষকতা করে অবসর গ্রহণ করেন। ঢাকায় স্বপরিবারে অবস্থান করছেন।
কন্যা জাহানারা বেগম দুলুঃ তিনিও ঢাকায় স্বপরিবারে অবস্থান করছেন।
পুত্র নুর ইসলামঃ বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন দপ্তরে চাকুরী করে অবসরে আছেন ঢাকাতে।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে লালমনিরহাটের বীর শহীদদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
লেখকঃ সম্পাদক, সাপ্তাহিক আলোর মনি, লালমনিরহাট।
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : অধ্যক্ষ মোঃ রবিউল ইসলাম মানিক
সম্পাদক : মোঃ মাসুদ রানা রাশেদ
প্রকাশক : মোঃ রমজান আলী
নির্বাহী সম্পাদক : মোঃ হেলাল হোসেন কবির
Copyright © 2024 আলোর মনি. All rights reserved.