পীর হাবিবুর রহমান
মতিহার ক্যাম্পাসে ৮৬ সালে ছুটির এক সকালে আমি ও সাবেরীন কাজলা গেটে নবাব ভাইর ষ্টুডিওতে ছবি কটা তুলেছিলাম। ষ্টুডিওতে এখনো প্রয়োজনে ছবি তুলতে গেলে আমার চোখে পানি ঝরে কিন্তু ছবি ভালো আসেনা। ক্যামেরাম্যান বাম হাত এক জায়গায় ধরে সরিয়ে নেন। বলেন তাকিয়ে থাকতে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখে পানি আসে তারপর ছবি তোলা শেষ হয়। নবাব ভাইর ছবি অসাধারন। সেই ফুজি কালার ফিল্মের আগমন কালে সাদাকালো সময়ের শেষদিকে নবাব ভাইর হাতের শট দুর্দান্ত ছিলো। এখনো খুঁজি আমি তাকে মনে মনে। আমি অগোছালো মানুষ। বৈষয়িক ও নই।ছবি সংগ্রহে নেই ছেলেবেলার, তারুন্যের, পেশাগত জীবনের। সেই সাদাকালো ছবিটি এখনো আছে। যেমন অনেক বই হারালেও বইয়ের সংগ্রহ খারাপ নয়।
মতিহারের সবুজ সাজানো ক্যাম্পাসের সাথে শান্তি নিকেতনের মিল খুঁজেন অনেকে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাতটি বছর আমার কেটেছে অবাধ স্বাধীনতায়। এরশাদ ভ্যাকেশনে এত বছর। যখন তখন আন্দোলনের দাবানলে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের বন্ধ, হল ত্যাগের নির্দেশ। রাজশাহী যাওয়া আসাকালে আরিচা নগরবাড়ির ফেরিচলাচল রাতে খুব উপভোগ করতাম। ঢাকায় যাওয়া আসাকালে সাতদিন করে থাকতাম। মধুর ক্যান্টিন, নেতাদের বাড়ি দেখা সাক্ষাৎ আর বন্ধুদের আড্ডা।
আমার সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ ছিলো শহীদুল্লাহ কলাভবনের দোতলায় উঠেই। নামলেই বিশাল লাইব্রেরীর দেয়ালে বসে আড্ডা। লাইব্রেরীতে আর যাওয়া হয়নি কখনো।প্যারিস রোড ধরে হাটলে কি যে প্রশান্তি। সেই সাথে আমতলা আর ছাত্রমিছিল। মমতাজ উদ্দিনের পাশেই স্কুলের বারান্দায় সাত সকালে সাত বন্ধুর চায়ের আড্ডা। ক্লাস প্রায় ফাঁকি।স্নিগ্ধ সকালে মেয়েদের হল থেকে মিছিলের মতোন শাড়িতে আসা তরুনীদের মুখ দর্শন ভালোই লাগতো। বান্ধবী ভাগ্য একসাথে চলা সাত বন্ধুর খারাপ ছিলো। দুপুরে খেয়ে ছাত্রছাত্রীরা ঘুমাতো।আমার আড্ডা চাই। অসহ্য ছিলো ঘুম। প্রেমিক ও বান্ধবীদের নোট ফটোস্টেট করে দেয়া ছাত্ররা বিকেল হলেই পরিপাটি হয়ে মেয়েদের হলের সামনে ভীড় আর স্লিপ পাঠিয়ে অভাগার মতোন দাঁড়িয়ে থাকতো। দেখতে মজাই লাগতো। মায়া লাগতো বিজ্ঞানের বন্ধুদের জন্য। আমরা যখন সন্ধ্যায় তুমুল আড্ডায় প্রানবন্ত, ওরা তখন ক্লান্ত হয়ে হলে ফিরতো। পদার্থবিদ্যায় পাশ করে পরে ব্যাংকের সকাল সন্ধ্যা চাকরি!
রাতের ক্যাম্পাসে রিক্সায় ঘুরে বেড়াতে দারুন লাগতো। যেমন লম্বা হরতাল। ৮৩ সালে ভর্তি হতেই চারবার যেতে হয়েছে। ১৪জন ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে শিবির হত্যা মামলায় দন্ডাদেশ, সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, এসব কারনে। এরশাদের সাথে সব দলের সংলাপ হলো। ১৫দলের নেত্রী শেখ হাসিনা সেখানে দন্ডাদেশ প্রত্যাহার করান। এই ক্যাম্পাস সবুজ বৃক্ষ, ফুলের বাগান, সারি সারি হল, ষ্টেডিয়াম, মসজিদ, শহীদ মিনার, জুবেরী ভবন, সিনেট ভবন আর স্থাপত্য শৈলীতেই মনোরম আকর্ষনীয় নয়। রাজনীতি কবিতা ও নাটক গান বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার তীর্থস্থান ছিলো। পন্ডিত সব দাপুটে শিক্ষক ছিলেন। প্রশাসনিক ভবনের সামনেই ৬৯'র শহীদ শিক্ষক জোহা সমায়িত।
একটি ছোট্ট ছেলে ছিলো বাদাম বিক্রি করতো।এমনি টাকা দিলে নেবেনা। বাদাম না কিনলে কাঁদবে।বিপদে পড়তে হতো সামনে দাঁড়ালে। ক্যাম্পাসে স্যার দুই প্রকার ছিলাম। শিক্ষকদের সবাই স্যার ডাকতেন, আর আমাদের ছাত্রদের সব টোকাই ও হোটেল ডাইনিং কর্মচারীরা স্যার ডাকতো।
ক্যাফেটারিয়া, আবুর ক্যান্টিন, বাবলাতলা, রাকসু ভবন, শহীদ মিনার, রাতের রেল ইস্টিশন ছিলো দুপুর বিকেল গভীর রাতের আড্ডা। হলে হলেতো ছিলোই। ক্যাম্পাসে সব ঝুপড়ি হোটেলে খেতে গিয়ে গেটিস ছিলো বাড়তি পাওনা। হলে হলে আড্ডা। শহরে সিনেমা দেখতে যাওয়া। প্রিন্সে চুলকাটা। রহমানিয়া হোটেলের গরুবোনা। সাত বছর বাড়ির পড়ার খরচ তুলেছি তুমুল আড্ডায়।পরীক্ষা এলে সাজেশন আছে নোট নেই।বন্ধুদের রুমে রুমে গিয়েও নোট পড়ে সারারাত দিনে পরীক্ষা। তবে বই কিনতাম নিয়মিত। কবিতা উপন্যাস, আত্মজীবনী বেশী। আমাদের এক বন্ধু বই পড়তোনা। বইয়ের দোকানে গেলেই হাতিয়ে নিতো পেশাদারদের মতোন। আমাদেরও দিতো। ছাত্র রাজনীতি, আড্ডা, বই, জীবনের সবচেয়ে বড় পাঠ।
আমার হাতের লেখা ছিলো আর্টিস্টিক। পোস্টার লেখার হাত তৈরি স্কুল জীবনেই। দৈনিক বার্তায় গল্প লিখতাম নিয়মিত। সমকাল নাটকের সাথেও জড়িত ছিলাম। ক্যাম্পাসের শুরুতেই গুরু ছিলেন রেহান উদ্দীন রেজু ভাই। মানে কবি জীবন রায়হান। তার হাত ধরেই প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আমি ও সাবেরীন। রেজু ভাই প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। পেশায় তিনি এলেননা, আমি এলাম! ডিপার্টমেন্টের হয়ে আন্তবিভাগীয় ক্রিকেট খেলেছি। হলের বার্ষিক সাহিত্য সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় উপস্থিত বক্তৃতায় প্রথম, উপস্থিত গল্পবলায় দ্বিতীয় সস্থান প্রথমবর্ষেই। কোনটাতেই স্থির ছিলামনা। অস্থিরতা ছিলো। ছাত্র রাজনীতিটা মন দিয়ে করেছি স্কুল জীবন থেকেই। রাজনীতি করার স্বপ্ন ছিলো মনে প্রানে। কেনো হয়নি তোলা থাক। ক্যাম্পাসের কত ঘটনা, কত মজার ঘটনা, লিখে শেষ করার না। কত শিক্ষকের স্নেহ, কত স্বজন, কত প্রিয় মুখ কতকাল দেখিনা। সময় বদলে গেছে। আমাদের সময়ের যৌবনের জৌলুসও হারিয়েছে অনেক।
খবর দেখলাম করোনায় যাদের টাক মাথা তাদের ঝুঁকি বেশী! ছবিটা দেখে মনে হলো ছবির ওই বয়সে করোনাকাল এলে পাত্তাই দিতামনা। বেপরোয়া হতাম। এখন হৃদয় মেরামত করা, মাথার চুল গেছে উড়ে। কত দুর্বল! ছবির সময়টা ফিরে পেতে ইচ্ছে করে খুব। খুউব ইচ্ছে করে। হালকা পাতলা শরীর, মাথাভর্তি চুল! নস্টালজিক হই। রাতের সুনসান নিরবতায় দখিনা জানালায় জেগে থাকতাম, এসএম হলে। প্রথমে ২৩৩পরে ২৩৪নম্বর কক্ষ। দখিনা জানালার বাইরে জোনাক উড়তো! কি দারুন! হঠাৎ ট্রেনের হুইসেল, মনকে ধরে টান দিতো!
টেবিলে বই ছিলো অনেক। পাশেই দেয়ালে মেরিলিন মনরোর সাদাকালো ছবি। যার তার প্রেমে পড়িনি। এরকম অনেক বিখ্যাতদের সাথে প্রনয়ের পাঠ ছিলো। প্রেমিক হতে হয় হৃদয়ক্ষয়ে, অংকের হিসেবে নয়। সুচিত্রা সেন আমাকে টানেনি, রেখা টেনেছিলো খুব। আমার মেয়ে ছোট থাকতে গল্পটা করতাম। কিছু বড় হলে বলতো, তোমার ফাজলামো কথা রাখবা? সে মাঝে মধ্যে বলে, তোমাকে কেউ আর ডাকেনা? বলি মাধুরী খুব যেতে বলে, করোনা গেলে কিছুদিন থেকে আসবো। সে বলে যাওতো দেখি! তাকে আর শক্তির মতোন বলিনা, যেতে পারি কিন্তু কেনো যাবো?
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : অধ্যক্ষ মোঃ রবিউল ইসলাম মানিক
সম্পাদক : মোঃ মাসুদ রানা রাশেদ
প্রকাশক : মোঃ রমজান আলী
নির্বাহী সম্পাদক : মোঃ হেলাল হোসেন কবির
Copyright © 2024 আলোর মনি. All rights reserved.