মোঃ মাসুদ রানা রাশেদ, লালমনিরহাট:
লালমনিরহাট জেলায় করোনা ভাইরাস সংক্রমণরোধে টানা প্রায় দুই মাসের লকডাউন চলেছে। এ কারণে স্বল্প সময়ের জন্য দোকান খোলা রাখছে। কুটির শিল্পের পণ্যের বেচা বিক্রি তেমন নেই। এর জেরে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে শতবছরের ঐতিহ্যবাহী ক্ষুদ্র কুটির শিল্প মৃৎ, বাঁশ ও বেত শিল্পের সাথে জড়িত কারিগর ও ব্যবসায়ীগণ। এমনই অবস্থায় মৃৎ, বাঁশ ও বেতের সামগ্রী তৈরির কারিগর ও ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছে আর্থিক প্রণোদনা দাবি করেছে। এই শিল্পের সাথে জড়িত কারিগররা চায় বিনা সুদে ঋণ। তাহলে তারা বেসরকারি এনজিও ও মহাজনের চড়াসুদের খপ্পর হতে বেড়িয়ে আসতে পাবে।
চৈত্র, বৈশাখ ও জৈষ্ঠ্য মাস ৩ মাস গ্রামেগঞ্জে নানা উৎস, মেলা ও হালখাতা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় কারুপণ্যের বা কুটির শিল্পের পণ্যের কেনা বেচা হয় খুবব ভালো। ধর্মীয় উৎসব ঈদ ও পুজাঁয় ঘর সাঁজাতে মানুষ মাটির তৈজসপত্র, বড়বড় রকমারি মাটির ঘরা, মাটির পট, পাটের তৈরি ছিঁকা,পুতুলসহ নানা ধরতের মাটির জিনিস কিনে। বৈশাখ মাসে হালখাতায় মিষ্টি ও দৈই রাখতে এবং গ্রাহকদের বাড়িতে নিয়ে যেতে মাটির হাঁড়ি এখনো গ্রামের হাটবাজারে ও প্রচলন আছে। এটা গ্রামবাংলার শতবছরের ঐতিহ্যর বহিপ্রকাশ। এখনো বাংলাদেশে ছোটবড় দৈইয়ের হাঁড়ি ও ঘঁটি মাটির তৈরি। এমন কী ছোট ছোট কাপ দৈই মাটির তৈরি কাপেই সরবরাহ করা হয়। সৌখিন মানুষ গ্রাম কিংবা শহরে এখনো ঐতিহ্যরক্ষায় বাঁশের তৈরি ও বেতের তৈরি আসবাবপত্র ব্যবহার করে। এসব বাঁশ ও বেতের তৈরি আসবাবপত্রে বর্তমান যুগে ডিজাইন ও রং বার্নিসে এসেছে আধুনিকতা। এসেছে নানা বৈচিত্রতা। তাই চাহিদাও আছে। শিল্পিরা(কারিগররা) গ্রাহকের চাহিদামত ডিজাইনে বাঁশ, বেত ও কাঁট ব্যবহার করে আসবাবপত্র তৈরি করে দিয়ে থাকে। এবারে তারা গ্রাম্য নানা উৎসব, মেলা, ঈদ ও পুজাঁর জন্য পন্য তৈরি করে রেখে ছিল। তারা নিজেদের, এনজিও’র ঋণ ও মহাজনদের কাছে ঋণ নিয়ে পন্য তৈরি করে মজুদ করে রেখে ছিল। কিন্তু লকডাউনের কারনে বেচা বিক্রি করতে পারেনি। এই শিল্পের ব্যবসায়ী ও কারিগররা তাদের পুঁজি বিনিয়োগ করে পণ্য তৈরি করে মজুদ করে রেখেছে। ফলে আটকে গেছে পুঁজি। বিক্রি করতে না পারায় বিনিয়োগকৃত পুঁজি ফেরত আসেনি। লাভতো দুরের কথা। এখন পণ্যের বিপরিতে আটকে যাওয়া পুঁজির সুদ গুনতে হচ্ছে। তাই কুটির শিল্পের সাথে জড়িতরা সরকারের কাছে বিনা সুদে ঋণ দাবি করেছে। সরকারি ঋণ পেলে তারা মহাজন ও এনজিও’র ঋণ মওকুব করে দিয়ে দায় মুক্ত হতে চায়।
লালমনিরহাট শহরের অর্থবেঙ্গল মোড়ের বেত ব্যবসায়ী ও কারিগর অর্জুন(৪৫) জানান, হাটবাজার, মেলা সবই বন্ধ। শহরে মানুষ আসছে না। তাই বেচা কেনা নেই। কাজের অর্ডারও নেই। রিসর্টগুলিও বন্ধ। তাই রিসোর্ট থেকেও অর্ডার আসছে না। কর্মচারিদের মজুরি দিতে পারিনা। তাই তাদের ছুটি দিয়ে দিয়েছি। এই অবস্থায় সংসার চালানো নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে এই কাজের সঙ্গে যুক্ত কারিগর ও ব্যবসায়ীরা। তাই এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প ও শিল্পীদের রক্ষা করতে হলে এই মূহুর্তে সরকারিভাবে বিনা সুদে ঋণ দেওয়া প্রয়োজন। সেই সাথে কর্মীদের খাদ্য সহায়তা সহ সরকারের সামাজিক নিরাপত্তামূলক অন্যান্য সরকারি সুযোগ সুবিধার দেয়ার দাবি উঠেছে। তিনি আরো বলেন, সংবাদপত্রে ও টিভির সংবাদে শুনেছি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষদ্র কুটির শিল্পের সাথে জড়িতদের প্রনোদনা দেবে। কোথায় আবেদন করতে হবে। কিভাবে সেই প্রণোদনা পাব তাতো জানা নেই। আমাদের সাথে কেউ যোগাযোগও করেনি। এমন কি বিসিকের কর্মকর্তারাও কোন যোগাযোগ করেনি।
লালমনিরহাট জেলার পাঁচটি উপজেলায় প্রায় প্রতিটি উপজেলায় দুই/চারটি বাঁশ ও বেতের সামগ্রী তৈরির ছোট ছোট পারিবারিক কারখানা ও বিক্রির দোকান আছে। এখানে বেতের চেয়ার, টেবিল, সোফা সহ বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করে বিক্রি করা হয়। বাঁশ দিয়ে তৈরি হয় ডালি, কুলা, মাছ মারার ডারকি ও বাঁশের চাটাই। মৃৎ শিল্পিরা তৈরি করে মাটির থালা বাসন, হাঁড়ি, টেগারি, দৈইয়ের ঘঁটি, মাটির রিং স্লাব, মাটির ছোট ছোট কাপ, নানা রংয়ের মটকা, রংবে রংয়ের ঘর সাঁজানো তৈজসপত্র, মাটির তৈরি হাতি, ঘোড়া, হরিণ, বাঘ ও মাটির পয়সা রাখা ব্যাংকসহ নানা খেলনা তৈরি করেছি। জেলা সদরের মোগলহাট ইউনিয়নের কুমারটারি গ্রামের মৃৎ শিল্পী শিল্পী রানি(৪২) জানান, ‘টানা লকডাউনে খুব সমস্যা হচ্ছে। অর্ডার আসছে না। বাজার ও দোকান বন্ধ থাকায় বিক্রিও হচ্ছে না। এবার কোন গ্রাম্য মেলা হয়নি। হয়নি গ্রামে ও শহরের ছোট বড় কোন দোকানে বৈশাখ মাসে হালখাতা। তাই কোন বেচা বিক্রি নেই। হাতে টাকা নেই, মাটির তৈরি পণ্য বানিয়ে (মাল) মজুদ করে বসে আছি। এসব পণ্য বানাতে মূলধন নিয়েছি বেসরকারি এনজিও হতে চড়া সুদে। অনেকে আবার স্থানীয় মহাজনদের কাছে দাদন নিয়েছে। পণ্য কেনা বেচা নেই। তাই ঋণ ও দাদন কিভাবে পরিশোধ করবো এই চিন্তায় বাঁচিনা। সংসার চালানো নিয়ে সমস্যায় পড়েছি।’ সন্তানদের খেতে দিতে পারি না। এমনিতেই প্লাষ্টিকের হরেক রকমের পণ্যের কাছে আমরা মার খাচ্ছি। আগেরমত বেঁচা কেনা নেই। বাপ দাদার এই শিল্পে এখন কেউ থাকতে চায় না। পেশা বদল করে ফেলেছে। এই গ্রামের ২৭টি হিন্দু পরিবার মৃৎ শিল্প নিয়ে এখনো বেঁচে আছে। তারা সরকারের কাছে আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি এই শিল্পের বৈদ্যূতিক আঁধুনিক যন্ত্রপাতি চায়। চায় আধুনিক তৈজসপত্র তৈরির প্রশিক্ষণ। চায় নতুন নতুন ডিজাইন। মাটির তৈরি জিনিস বিদেশে রফতানি করতে তারা সরকারের সহায়তা চায়। মৃৎ শিল্পীরা দাবি করেন, বিয়ে ও সামাজিক অনুষ্ঠানে ওয়ানটাইক প্লাষ্টিকের থালা ও গ্লাসের পরিবর্তে যাতে মাটির তৈরি থালা ও গ্লাস ব্যবহার করা হয়। সেজন্য পরিবেশের ক্ষতিকর প্লাষ্টিকের ওয়ানটাইম থালা ও গ্লাস যাতে সরকার নিষিদ্ধ করে আর্দেশজারি করে। আমাদের দেশে এখনো মৃৎ, বাঁশ ও বেত শিল্প টিকে আছে। এখনো কৃষিজ অর্থনীতিতে এই শিল্পের রয়েছে বিরাট ভূমিকা। কোন কোন ক্ষেত্রে এই শিল্পের পণ্য বিদেশে রফতানি করে অর্জিত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। গ্রামে ও শহরে একনো দৈনন্দিন জীবনে এখনো মাটির তৈরি, বাঁশের তৈরি ও বেতের তৈরি ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এই শিল্পে আধুনিক প্রশিক্ষণ, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও নতুন নতুন ডিজাইন তৈরি করা গেলে এই পণ্যের চাহিদাও বাড়বে। সেই সাথে অনেক অর্ধশিক্ষিত ও শিক্ষিত বেকার যুব ও যুব মহিলাদের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। এই শিল্পের সাথে জড়িতদের সামাজিক মর্যাদাও বাড়বে।
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : অধ্যক্ষ মোঃ রবিউল ইসলাম মানিক
সম্পাদক : মোঃ মাসুদ রানা রাশেদ
প্রকাশক : মোঃ রমজান আলী
নির্বাহী সম্পাদক : মোঃ হেলাল হোসেন কবির
Copyright © 2024 আলোর মনি. All rights reserved.