মোঃ মাসুদ রানা রাশেদ লালমনিরহাট:
লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী ইউনিয়নের পোশাক শ্রমিক মৌসুমী আক্তারের রহস্যজনক মৃত্যু ও তার লাশ তিস্তা নদীতে পাওয়া নিয়ে কাটছে না ধূম্রজাল। ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরার পথে যে ট্রাকের ধাক্কায় মৌসুমীর মৃত্যু হয়েছে বলা হচ্ছে, সেটির চালক-হেলপারকে রংপুর তাজহাট পুলিশ আটক করলেও তাদের নিজ জিম্মায় ছাড়িয়ে নিয়েছেন তার বাবা!
এমনকি ট্রাক চালক আজিজুল ইসলাম ও হেলপার রতনের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করতে রাজি হননি মৌসুমীর বাবা গোলাম মোস্তফা। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় তার বিভিন্নরকম বক্তব্য দেওয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
রংপুর মহানগর তাজহাট থানার অফিসার ইনচার্জ শেখ রোকনুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, গত ২২ মে বিকেলে আমরা মৌসুমীর লাশ উদ্ধার করি। পরে ট্রাকের চালক আজিজুল ইসলাম ও হেলপার রতনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসি। মৌসুমী আক্তারের মৃত্যু কীভাবে হয়েছে তা জানতে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
অফিসার ইনচার্জ আরও সাংবাদিকদের বলেন, ২৩ মে মৌসুমীর ময়নাতদন্ত শেষে বাবা গোলাম মোস্তফার কাছে লাশ হস্তান্তর করি। এ সময় তাকে আমার ফোন নম্বর দেওয়া হয় এবং রাস্তায় যেতে কোনো সমস্যা হলে জানাতে বলি। মৌসুমীর বাবা তার মেয়ের মৃত্যু নিয়ে ও লাশ এলাকায় নিয়ে যেতে বাঁধা পাচ্ছে এমন কোনো অভিযোগও করেননি। তিনি আটক চালক ও হেলপারের বিরুদ্ধেও কোনো অভিযোগ করেননি, বরং তাদের থানা থেকে নিজ জিম্মায় ছাড়িয়ে নিয়ে গেছেন। এ কারণে আমরা থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করি। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসলে মৃত্যুর রহস্য বের হবে।
মৌসুমীর লাশ পরিবহনকারী গাড়ির চালক নাঈম সাংবাদিকদের বলেন, তাজহাট থানা থেকে ডাকলে প্রথম দিন লাশ উদ্ধার করে প্রথমে থানায় পরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। পরের দিন আমি লাশ নিয়ে বুড়িমারী যেতে থাকি। পথিমধ্যে বড়খাতা এলাকায় মৌসুমীর বাবা একটি ভ্যান ডেকে সমস্যার কথা বলে লাশ নামিয়ে নেয়। তারপর লাশ নিয়ে তিনি কোথায় গেলেন তা আমি জানি না।
লাশ দাফনের নাম করে চালক নাঈম ৫হাজার টাকা নিয়েছেন এমন অভিযোগ করেন মৌসুমীর বাবা। এ ব্যাপারে তাকে প্রশ্ন করা হলে অভিযোগটি সত্য নয় বলে জানান তিনি।
গোলাম মোস্তফা দাবি করেছিলেন, তার মেয়ের লাশ দাফনের সময় করোনা রোগী সন্দেহে বাধা পাওয়ায় রংপুরের এক লাশ পরিবহনকারী গাড়ির চালকের কাছে দেওয়া হয়। লাশটি বুড়িমারীতে পাঠানোর কথা বলে নাঈমকে ৫হাজার টাকা দিয়ে তিনি নিজ এলাকায় চলে আসেন। পরে নাঈম মৌসুমীর লাশ কী করেছে, সেটি জানেন না তিনি।
মৌসুমীর লাশ পাওয়া ও দাফন নিয়ে প্রশ্ন: লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী ইউনিয়নের গার্মেন্টস কর্মী মৌসুমী আক্তারের মৃত্যুকে ঘিরে নতুন নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। রংপুর মহানগর পুলিশ মৌসুমীর লাশ ময়নাতদন্ত শেষে দাফনের জন্য তার বাবা গোলাম মোস্তফার কাছে হস্তান্তর করলেও সেই লাশ দাফন না করে নদীতে কারা ফেলে দিলো? লাশ যাতে এলাকায় নিয়ে আসা না হয় এ জন্য কারা বুড়িমারীতে বিক্ষোভ করল? সুস্থ মৌসুমী আক্তার কীভাবে ট্রাকে মারা গেলেন? ট্রাকচালক ও হেলপারকে আটকের পরও কী কারণে পুলিশ তাদের ছেড়ে দিলো?
তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো মৌসুমীর বাবা গোলাম মোস্তফা কেন ট্রাক চালক-হেলপারকে থানা থেকে নিজ জিম্মায় ছাড়িয়ে নিয়ে গেলেন? কেন তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করতে রাজি হননি? এ ছাড়া পুরো ঘটনা নিয়ে গোলাম মোস্তফা, মৌসুমীর মা সাহেরা বেগম, তার দুই বোন শান্তনা ও রুমানা এবং লাশ পরিবাহনকারী গাড়ির চালক ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন। তবে এ মৃত্যুকে ঘিরে নানা প্রশ্নের উত্তর বের করতে ও প্রকৃত রহস্য খুঁজতে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা তদন্তে নেমেছে। ইতিমধ্যে লালমনিরহাট অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা মৌসুমীর বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যদের একাধিক বার কথা বলেছেন।
আদিতমারী থানার অফিসার ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, মৌসুমীর লাশ নদীতে পাওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সহকারে দেখা হচ্ছে। মৌসুমীর বাবা ও গাড়ির চালক ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন। আশা করছি, মূল রহস্য বের করতে পারবো।
পাটগ্রাম থানার অফিসার ইনচার্জ সুমন কুমার মোহন্ত সাংবাদিকদের বলেন, পুরো ঘটনা নিয়ে তার পরিবারের সদস্যরা ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন। ফলে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বিষয়টি গুরুত্বর সহকারে তদন্ত করছেন। প্রকৃত রহস্য বের করতে একটু সময় লাগবে।
উল্লেখ্য, মৌসুমী নামে এক গার্মেন্টস কর্মী ঢাকা থেকে তার বাড়ি লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারীতে ফেরার পথে ২২ মে ট্রাকে রহস্যজনক মৃত্যুর শিকার হয়। তার লাশ রংপুর তাজহাট থানা পুলিশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত শেষে ২৩ মে তার বাবার কাছে হস্তান্তর করে। কিন্তু লাশ দাফন না করে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। ২৪ মে মৌসুমীর লাশ লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী এলাকায় তিস্তা নদী থেকে উদ্ধার করে পুলিশ।