লালমনিরহাটে সবজি ছেড়ে তামাক চাষে ঝুঁকছেন কৃষকেরা। চলতি মৌসুমে লালমনিরহাট জেলার ৫টি উপজেলায় মোট ১৫হাজার ৫৭হেক্টর জমিতে তামাকের চাষ হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় ৯হাজার ৮শত ৬৫হেক্টরের বেশি জমিতে তামাক চাষ বেশি হয়েছে। তামাক কোম্পানীগুলোর লোভনীয় অফার ও লজিস্টিক সাপোর্টের কারণে কৃষকরা তামাক চাষে উৎসাহ পাচ্ছেন। এসব তামাক চাষের ফলে নষ্ট হয় জমির উর্বরতা। তামাকের বিষাক্ত উপাদান শিশু স্বাস্থ্যের জন্যে ঝুঁকিপূর্ণ, এর ফলে ক্যান্সারের প্রবণতা রয়েছে। এছাড়া বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহার ও তামাকের নিকোটিনের প্রভাবে দূষিত হচ্ছে নদীর পানি। যার কারণে তামাক খেতের পার্শ্ববর্তী নদীগুলোয় মাছের প্রজনন কমে গিয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, অসাধু তামাক কোম্পানীগুলো কৃষকদের ভুল বুঝিয়ে তামাক চাষে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। কৃষকদের আর্থিক সহায়তা, সার, বীজ ও ইত্যাদি মাধ্যমে তামাক কোম্পানীগুলো সুবিধা আদায় করছে। এদিকে পুঁজি ছাড়া ব্যবসা হওয়ায় ও অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের আশায় তামাক চাষে যাচ্ছে অধিকাংশ কৃষক।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, লালমনিরহাট জেলার তিস্তা, ধরলা, রত্নাই, স্বর্ণামতি, শিংগীমারী, সানিয়াজান, ত্রিমোহনী, সাকোয়া, মরাসতি, ধোলাই, গিদারী, ছিনাকাটা নদীর দুই তীরে চাষ করা হয়েছে তামাকের। যেখানে এক সময় ধান, ভূট্টান ও সবজি চাষাবাদ হতো, সেসব জমিগুলো এখন দখলে নিয়েছে তামাক ক্ষেত। একই চিত্র লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলা জুড়েও। এই জেলার ৪৫টি ইউনিয়নের মধ্যে সবকটি ইউনিয়নে তামাকের চাষ হচ্ছে।
বর্ষায় নদীর দু’কূল উপচে ঢলের পানিতে পলি জমে। আর সেই উর্বর জমির বেশির ভাগই তামাকের দখলে চলে যায়। অথচ নদীর আশপাশের স্বল্প উর্বর জমিতে বাদাম, ভুট্টা, সরিষা, শাক-সবজি, সূর্যমুখী ফুল ও বোরোর আবাদ হয়েছে। এখানকার মানুষ প্রাকৃতিক এবং গভীর ও অগভীর সেচ পাম্পের পানি নির্ভর। সেক্ষেত্রে তিস্তা, ধরলা, রত্নাই, স্বর্ণামতি, শিংগীমারী, সানিয়াজান, ত্রিমোহনী, সাকোয়া, মরাসতি, ধোলাই, গিদারী, ছিনাকাটা নদী অন্যতম ভরসা। বর্তমানে যা অনিরাপদ হয়ে উঠছে। তামাক চাষে ব্যবহৃত অতিমাত্রার সার কীটনাশক ও তামাকের রাসায়নিক উপাদান ক্রমেই নদী ও জলাশয়ের পানিতে মিশে পানি দূষণ করছে। বিশেষ করে মাছের ডিম পাড়ার মৌসুমে কীটনাশকযুক্ত পানির কারণে মাছ তার বংশ বিস্তারের অনুকূল পরিবেশ হারাচ্ছে। আরও একটি আশঙ্কার বিষয় হলো, তামাক চাষ ও প্রক্রিয়াকরণ কাজে সম্পৃক্ত থাকার কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকায় শিশু-কিশোরদের বিদ্যালয়ে উপস্থিতির হার দিন দিন কমে আসছে। বাড়ছে ক্যান্সারের ঝুঁকি, হারাচ্ছে জমির উর্বরতা, নদী দূষণে কমছে মাছের প্রজনন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এই তামাকের ক্ষতিকর প্রভাবে ভূমির উর্বরতা নষ্ট হয়ে যায়। যে জমিতে একবার তামাক চাষ করা হয়, সে জমিতে অন্য ফসল সহজে হয় না। ফসলের জন্যে হুমকি স্বরূপ এই বিষাক্ত তামাক। তামাক কোম্পানীগুলোর প্রলোভনে পড়ে বেশি লাভের আশায় প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে তামাক চাষে জড়িয়ে পড়েন অর্থলোভী কিছু কৃষক।
বিশেষজ্ঞদের মতে, তামাক রোপণ থেকে শুরু করে পাতা কাটা এবং শুকানো পর্যন্ত এর সব প্রক্রিয়াতে রয়েছে বিষাক্ত উপাদান। কৃষকরা ভয়াল এ বিষ সম্পর্কে জানার পরেও অতিরিক্ত লাভের আশায় তামাক চাষে যাচ্ছেন। এর পরিচর্যায় কৃষকরা নিজেদের পাশাপাশি পরিবারের স্ত্রী ও কোমলমতি শিশুদেরও ব্যবহার করছে। ফলে বাড়ছে ক্যান্সারসহ তামাকজনিত বিভিন্ন রোগের প্রকোপ। স্বাস্থ্য ও পরিবেশে ঝুঁকি জেনেও অনেকেই অতিরিক্ত লাভের আশায় তামাক চাষ ছাড়তে পারছে না।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে ইতোমধ্যে বেশ ক’টি বেসরকারি সংস্থা লালমনিরহাট জেলায় কাজ করলেও কৃষকের পক্ষ থেকে তামাক চাষ বন্ধে কোনো ধরণের আগ্রহ নেই।
লালমনিরহাট সিভিল সার্জন ডাঃ আব্দুল হাকিম বলেন, তামাক চাষ ও সেবনে মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তামাক পাতার বিড়ি, সিগারেট, গুল, খইনি ও জর্দাসহ নানান ধরনের নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবন করায় বাড়ছে শ্বাসকষ্ট, স্ট্রোক, চর্ম , যৌন, ক্যান্সারসহ নানা রোগ। তামাক চাষের কারণে কৃষকদের পাশাপাশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন শিশুসহ, সাধারণ মানুষ।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ ড. মোঃ সাইখুল আরিফিন জানান, কৃষি জমি এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য তামাক চাষ মারাত্মক ক্ষতিকর। আমাদের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সভা, সেমিনার ও উঠান বৈঠকের মাধ্যমে কৃষকদের তামাক চাষের প্রতি নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। তবে তামাকজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কৃষকদের বিনামূল্যে তামাকের বীজ, সারসহ, বিনা সুদে ঋণ দেওয়া ও অধিক লাভজনক হওয়ায় কোন পরামর্শই কাজে আসছে না। যে কারণে তামাক চাষে আগ্রহী বেশি হচ্ছে এ অঞ্চলের কৃষকরা বলে তিনি দাবি করেন।