স্বপ্ন ছিল নিজেই উপার্জন করে বসত ভিটা কিনে বাবা-মাকে একটা বাড়ি করে দেওয়ার আর এই চিন্তা ভাবনা নিয়েই দেশের উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা লালমনিরহাট থেকে রাজধানী ঢাকায় ছুটে যাওয়া শাহিনুরের। কিন্তু সেই ইচ্ছে যেন মাটিতে বিলীন হয়ে গেছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। বলছি লালমনিরহাট জেলা লালমনিরহাট সদর উপজেলার বড়বাড়ী ইউনিয়নের বড় বাসুরিয়া গ্রামের মোঃ শাহিনুর আলমের (১৯) কথা।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সোমবার (৫ আগস্ট) সরকার পতনের পর মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) সকাল ৮টা ৩০মিনিটে রাজধানী ঢাকার কামরাঙ্গীরচর এলাকার লালবাগ থানার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন শাহিনুর আলম। এমতাবস্থায় চলছিল থানার সামনে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিজয় মিছিল। ঠিক সেই সময় মিছিলে যোগ দিলে হঠাৎ করে থানার ভেতর থেকে পুলিশ অতর্কিতভাবে গুলি চালাতে থাকে। আর সেই গুলি লেগে শাহিনুর আলম রাস্তায় পড়ে যায়।
পরে তাকে স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন স্বপ্নবাজ এই ছেলেটি। পরে মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) রাতে তার লাশ নিজ বাড়িতে নিয়ে এসে বড়বাড়ী ইউনিয়নের খেদাবাগের কেন্দ্রীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়।
মোঃ শাহিনুর আলম (১৯) লালমনিরহাট সদর উপজেলার বড়বাড়ী ইউনিয়নের বড় বাসুরিয়া গ্রামের মোঃ আব্দুল জব্বার (৫৭) ও মোছাঃ মাছিরন বেগম (৫৩) এর তৃতীয় ছেলে ছিলেন।
মোঃ মাজেদুল ইসলাম (২৪) ও মোঃ সাইদুল ইসলাম (২১) নামে ২ জন বড় ভাই এবং মোছাঃ মাজেদা বেগম (২৩) ও মোছাঃ মারুফা খাতুন (১২) নামে তার আরও ২জন বোন রয়েছে। শাহিনুর আলম ভাই-বোনদের মধ্যে তৃতীয়। ভাই মাজেদুল ইসলাম ও সাইদুল ইসলাম ২জনেই অটোরিক্সা চালক। বোন মাজেদা বেগমের বিয়ে হয়েছে। তিনি একজন গৃহিণী। ছোট বোন মারুফা খাতুন মোহাম্মদবাগ আদর্শ নুরানী হাফিজিয়া মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। শাহিনুর আলম দারূস সুন্নাহ হাফিজিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ছিলেন।
পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কারণে পড়াশোনা বাদ দিয়ে ঢাকার কামরাঙ্গীরচর এলাকায় একটি ছাত্রাবাসে থেকে অটোরিকশা চালাতেন তিনি। অটোরিকশা চালিয়ে যে টাকা উপার্জন করতেন তার বড় একটি অংশ বাবার হাতে তুলে দিতেন। মূলত তার টাকায় ছোট বোন মারুফা খাতুনের পড়াশুনাসহ তার বাবার সংসার চলতো।
গ্রামবাসী জানায়, শাহিনুর আলম একজন নম্র, ভদ্র ছেলে হিসেবে পরিচিত ছিল আর তাই আমরা শাহিনুর আলম সড়ক নামে একটি রাস্তার নামকরণ করেছি।
বাবা আব্দুল জব্বার বলেন, আমার অনেক বয়স হয়ে গেছে, এখন তেমন কাজকর্ম করতে পারি না। আগে মানুষের জমিতে কাজ করে টাকা উপার্জন করতাম। আমার নিজের বলতে কিছুই নেই। সরকারি খাসের জমিতে বাড়ি করে থাকি আমরা। নিজের কোন জায়গা-জমি নেই। আমার যেই ছেলে টাকা পয়সা দিয়ে আমাদের সাহায্য করত তাকেই তারা গুলি করে পৃথিবী থেকে বিদায় করে দিলো। তার মৃত্যুতে ভেঙ্গে পড়েছে আমার পুরো পরিবারের উপার্জনের চাকা। অন্যদিকে আমার স্ত্রী ছেলে হারানোর শোকে পাগল হয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত এখন তার চিকিৎসা করতে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সরকার যদি আমাদের সংসারের খোঁজ খবর রাখে এবং সাহায্য করে তাহলে আমাদের অসচ্ছল পরিবারটি হয়তো আবারো আগের মতো করে ঘুরে দাঁড়াবে।
আর্থিকভাবে সাহায্য পেয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে শাহিনুর আলমের বাবা বলেন, তেমন কোন আর্থিক সাহায্য পায়নি তবে বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও লালমনিরহাট জেলা বিএনপির সভাপতি অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু ভাই আমার হাতে ৭০হাজার টাকা তুলে দিয়েছে। তাছাড়া এখন পর্যন্ত অনেকেই বাড়িতে আসলেও কেউ কোন টাকা পয়সা দেয়নি।
তিনি আরও বলেন, আমার ছেলেসহ দেশের এই আন্দোলনে যতো মায়ের বুক খালি হয়েছে আর যারা এই খুনের সঙ্গে জড়িত আমি তাদের প্রত্যেককে বিচারের আওতায় দেখতে চাই। বর্তমান সরকারের প্রতি এ ব্যাপারে আমার অনুরোধ থাকলো।
শাহিনুর আলমের মা মাছিরন বেগম চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলেন, আমার ছেলেকে ওরা মেরে ফেলেছে। আমি এখন কার মুখ দেখে বেঁচে থাকব! কে আমারে ওষুধের টাকা দেবে? কে আমার জামা-কাপড়ের টাকা দিবে? কে আমার ছোট মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালাবে? আর কেই বা আমারে মা বলে ডাকবে।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার বড়বাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ নাজমুল হুদা লিমন জানান, আমি নিজেই শাহিনুর আলমের পরিবার সম্পর্কে অবগত রয়েছি। তার মৃত্যুতে আমি নিজেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। ওই পরিবারটি অনেক অভাবগ্রস্ত। মূলত শাহিনুরের টাকায় তার বাবা মা খেয়ে পড়ে চলতো। এখন তো তাদের সেও নেই, তাই হয়তো খুব অর্থ সংকটে ভুগবে।
তিনি আরও বলেন, আমি আমার ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে চেষ্টা করবো আর্থিক সাহায্য করার।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক ও বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এইচ এম রকিব হায়দার বলেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যেসব পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে আমরা সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সহযোগিতার সব রকম ব্যবস্থা করব।