লালমনিরহাট জেলার ৫টি (লালমনিরহাট সদর, আদিতমারী, কালীগঞ্জ, হাতীবান্ধা, পাটগ্রাম) উপজেলার ৪৫টি ইউনিয়ন, ২টি (লালমনিরহাট, পাটগ্রাম) পৌরসভার বিভিন্ন স্পটে দিন-রাত সমানতালে চলছে মাদকদ্রব্যের রমরমা ব্যবসা। মাদক পরিবহন ও বিক্রি রোধে পুলিশ প্রশাসনের ব্যাপক অভিযানে মাদকদ্রব্য উদ্ধার এবং গ্রেফতারের পরেও এতে মাদক বিক্রেতা ও মাদকাসক্তের সংখ্যা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। মাদকদ্রব্যের ক্রেতাদের মধ্যে বেশির ভাগই তরুণ ও যুবক শ্রেণীর হওয়ায় অভিভাবকদের মধ্যে দেখা নিয়েছে চরম হতাশা ও আতঙ্ক।
জানা গেছে, লালমনিরহাটের ছোট-বড় বিভিন্ন স্পটে হাত বাড়ালেই ফেন্সিডিল, হেরোইনসহ সব রকম মাদকই পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি ইয়াবা ট্যাবলেটও রয়েছে মাদকসেবীদের নাগালের মধ্যে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, লালমনিরহাট জেলা জুড়ে গড়ে উঠেছে মাদক সেবনকারী ও পাচারকারী চক্রের এক অলৌকিক শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। জেলার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে চোরাই পথে যেমন ভারত থেকে আসছে নানা নেশা দ্রব্য, তেমনি এখানে বাড়ছে মাদকসেবীর সংখ্যা। বিশেষ করে তরুন ও যুব সমাজ এর যারা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সব চেয়ে বেশি। যেন দেখার কেউ নেই। নেশার টাকা জোগার করতে গিয়ে এদের অনেকেই জড়িয়ে পড়ছে চুরি, ছিনতাইসহ নানা ধরণের অপরাধমূলক কাজে। মাদক দ্রব্যের বিক্রি ও ব্যবহার এতটাই অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, জেলার পাড়া, মহল্লা, গ্রামে-গঞ্জে স্বতঃস্ফুর্তভাবে হাতের নাগালে পাওয়া যাচ্ছে এ মরণ নেশা মাদক।
মাদকদ্রব্য আসছে যে পথে ধরেঃ জেলার অধিকাংশ সীমান্ত পথে যেমন- কুলাঘাট, মোগলহাট, দূর্গাপুর, চন্দ্রপুর, বড়খাতা, বাউড়া, জোংড়া, শ্রীরামপুর, লোহাকুচি, বুড়িরহাট, জাওয়ানী, দইখাওয়া, কুচলিবাড়ী, জগতবেড়, বুড়িমারীসহ বিভিন্ন সীমান্ত গ্রামগুলো দিয়ে অনেকটা প্রকাশে কি দিন কি রাত যে কোন সময় অবাধে ভারত থেকে ঢুকছে ফেন্সিডিল, গাঁজা, আফিম, নেশার ঔষধ, হেরোইনসহ অন্যান্য মাদক দ্রব্য।
জেলার বহুল আলোচিত পরিচিত মাদক স্পটগুলোতে প্রতিদিন সকাল-দুপুর-বিকাল-সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে মাদকদ্রব্য সেবন, বিক্রি ও পরিবহণ নেটওয়ার্কের তৎপরতা।
মাদকদ্রব্যের অভ্যন্তরিন রুট গুলোঃ পাশ্ববর্তী কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী বালারহাট ও গোড়ক মন্ডল হয়ে সড়ক পথে এসে ধরলা নদী পার হয়ে লালমনিরহাট সদর উপজেলার কুলাঘাটে মাদক প্রবেশ করে। তারপর সড়ক পথে টিকটিকিরহাট, বড়বাড়ী হয়ে তিস্তা রেলওয়ে ব্রীজ পার হয়ে রংপুর জেলার কাউনিয়ায় প্রবেশ করে। সেখান থেকে রেল ও নদী পথে সারা দেশে ছড়িয়ে পরে।
এছাড়া ফুলবাড়ী উপজেলার গোঁড়ক মণ্ডল হয়ে মাদক ধরলা নদী পার হয়ে সড়ক পথে লালমনিরহাট সদর উপজেলার মোগলহাট ইউনিয়নে আসে। সেখান থেকে একই ইউনিয়নের কর্ণপুর, বুমকা, ইটাপোতা, মেঘারাম, ফুলগাছ, কোদালখাতা, ভাটিবাড়ী, কাকেয়া টেপা হয়ে লালমনিরহাট পৌরসভায় প্রবেশ করে। তারপর লালমনিরহাট সদর উপজেলার কুলাঘাট ইউনিয়নের বড়ুয়া গ্রাম হয়ে বড়বাড়ীতে প্রবেশ করে। বড়বাড়ী হয়ে সড়ক পথে তিস্তা হয়ে রংপুরের কাউনিয়ায় প্রবেশ করে।
এছাড়াও আদিতমারী উপজেলার সীমান্তবর্তী দূর্গাপুর ইউনিয়নের বিপরীতে ভারতের গিদারী নদী পার হয়ে দরিবস এলাকা দিয়ে বাংলাদেশের উত্তর গোবধা বসিনটারী হয়ে সাপ্টিবাড়ীতে প্রবেশ করে মাদক। সেখান থেকে সড়ক পথে একই উপজেলার ভেলাবাড়ী হয়ে সারপুকুর ইউনিয়নের রইচবাগ, টিপার বাজার হয়ে মহিষখোচা প্রবেশ করে। সেখান থেকে তিস্তা নদী পার হয়ে রংপুরের হারাগাছ দিয়ে সারা দেশে সড়ক, নদী ও রেল পথে চলে যায়।
কালীগঞ্জ উপজেলার চাপারহাট ও লোহাকুচি হয়ে কাকিনায় প্রবেশ করে। সেখান থেকে কাকিনা-মহিপুর ঘাট হয়ে রংপুরে প্রবেশ করে সারা দেশে সড়ক ও রেল পথে চলে যায়।
এছাড়া জেলার পাটগ্রাম উপজেলার সীমান্তবর্তী শ্রীরামপুর, বুড়িমারী ও জোংড়া ইউনিয়ন হয়ে সড়ক পথে বাউরায় ঢুকে। সেখান থেকে জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার বড়খাতা ইউনিয়ন হয়ে সড়ক পথে দোয়ানী হয়ে ডালিয়ায় প্রবেশ করে। সেখান থেকে সড়ক পথে নীলফামারী হয়ে সৈয়দপুরে প্রবেশ করে। সেখানে থেকে সড়ক ও রেল পথে ছড়িয়ে পরে ভারত থেকে আসা সব মাদকদ্রব্য।
এছাড়া লালমনিরহাট থেকে সড়ক পথে চলাচলকারী অধিকাংশ বাস ও নাইটকোচ এবং লালমনিরহাট- ঢাকা-লালমনিরহাট চলাকালীন রেলওয়ে ট্রেন থেকে মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছে। এসব পথে মাদকদ্রব্য চলাচলের অভিযোগ দীর্ঘদিনের পুরোনো।
জানা যায়, চোরাইপথে এসব আনতে চোরাচালানি গ্রুপের সদস্যরা সীমান্ত ঘেঁষা গ্রামগুলোতে অস্থায়ীভাবে অবস্থান নেয়। তারা সুযোগ বুঝে অথবা সুযোগ সৃষ্টি করে প্রতিনিয়ত কৌশল পরিবর্তন করে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। মাদক দেশের অভ্যন্তরে এনে সরাসরি দৃস্কৃতিকারীদের হাতে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় পৌঁছে দিচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, এলাকার কতিপয় প্রভাবশালী মাদক ব্যবসায়ে মূলধন বিনিয়োগ করছে। ওই প্রভাবশালীদের ছত্রছায়াতেই চলছে হরেক রকম মাদকের জমজমাট ব্যবসা। এখন লালমনিরহাট জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম ও পাড়া-মহল্লার ছড়িয়ে পড়ছে মাদকদ্রব্য। প্রভাবশালীদের দাপটে প্রশাসন ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নিতে পারছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। আবার কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা নিয়ে থাকে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ জন্য মাদক ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত রাঘব-বোয়ালদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কোন পদক্ষেপ নেয়া হয় না। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
লালমনিরহাটের বিভিন্ন এলাকার মাদক ব্যবসায়ীরা পাইকারী ও খুচরা বাংলামদ, গাঁজা, ফেন্সিডিল, হেরোইন এবং ইয়াবা ট্যাবলেট বিক্রি করছে। মাদক পাচার ও বিক্রির জন্য ব্যবসায়ীরা গড়ে তুলেছে গোপন মজুদখানা। এসব মজুদের আশ-পাশে রয়েছে আখড়া।
এক শ্রেণীর যুবক সার্টের হাতার ভাঁজে, প্যান্টের পকেটে, মানি ব্যাগের ভেতরে গাঁজা, হেরোইনের পুড়িয়া ও ইয়াবা ট্যাবলেট রেখে বিক্রি করছে। পোষাক-আষাক, চাল-চলনে ফিটফাট ওই যুবকদের দেখে বোঝার উপার নেই যে, তারা ভ্রাম্যমান মাদক বিক্রেতা। আর এসব মাদক ভ্রাম্যমান বিক্রেতারা তাদের মাদক বিক্রির উপর তাদের কমিশন পেয়ে থাকেন।
অল্প বয়সী ছেলে-মেয়ে ও নারীদের দিয়ে নির্বিঘ্নে মাদক ব্যবসায়ীরা এ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ব্যাপারে প্রশাসন রয়েছে নিরব।
আসুন, আমার দৃঢ়ভাবে শপথ নেই মাদককে না।