আলোর মনি ডটকম ডেস্ক রিপোর্ট: লালমনিরহাট জেলার প্রধান দুটি নদী তিস্তা ও ধরলা খুবই খরস্রোতা নদী। ২৪ঘন্টায় নদীর পানি হ্রাস পেয়েছে। দেখা দিয়েছে তীব্র নদী ভাঙ্গণ। তিস্তা ও ধরলা পাড়ে ২৪ঘন্টায় প্রায় ২শত পরিবার নদী ভাঙ্গণে বসত ভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। ধরলা নদীর ভাঙ্গণে বাংলাদেশের ভূ-খন্ড কমে যাচ্ছে। চর জাগছে ভারতে।
জানা গেছে, ভারতের উজানের পাহাড়ি ঢল ও ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি ২দিন আগে বিপদ সীমা অতিক্রম করে প্রবাহিত হয়। এতে প্রায় ৫০টি চরের প্রায় ২০হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। আজ শুক্রবার ৩ জুলাই তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি কমে বিপদ সীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদী ২টি খুবই খরস্রোতা। দেখা দিয়েছে তীব্র স্রোত। এই স্রোতের কারণে তিস্তা ও ধরলা পাড়ে দেখা দিয়েছে তীব্র নদী ভাঙ্গণ। গত ২৪ঘন্টায় ব্যাপক নদী ভাঙ্গণে প্রায় ২শতাধিক পরিবারের ঘর-বাড়ি, গাছ-পালা ও আবাদী জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তারা রাতারাতি নিঃস্ব হয়ে পথে বসে গেছে। গতকালকে ছিল আমির, আজকে হয়ে গেছে ফকির। নিঃস্ব পরিবারগুলো আশ্রয়ে আশায় কেউ কেউ অন্যত্র নিকট আত্মীয়-স্বজনদের কাছে চলে গেছে। কেউ কেউ উচুঁ বাঁধের রাস্তায় ও সরকারি জমিতে ঝুঁপড়ি ঘর তুলে আশ্রয় নিয়েছে। কেউ কেউ সরকারি স্কুল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে। নদীর অব্যাহত ভাঙ্গণে আতঙ্কে রয়েছে আরও শত শত পরিবার।
তিস্তা নদীর বাম তীরে লালমনিরহাট সদর উপজেলার চর গোকুন্ডা, খুনিয়াগাছ। আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা, বারোঘরিয়া, সর্দ্দার পাড়া র্স্পার। হাতীবান্ধা উপজেলার সিন্দুর্না, ডাউয়ামারী, গড্ডিমারী, হলদিবাড়ি, পাটিকাপাড়া, পারুলিয়া।
ধরলা নদীর ডান তীরে লালমনিরহাট সদর উপজেলার মোগলহাট, কর্ণপুর, ৬মাথা, খারুয়া, শকুনের ঘাট, দূর্গাপুর, চর ফলিমারী, কুলাঘাট ও বড়বাড়ী এলাকায় নদী ভাঙ্গণ দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় ২শতাধিক বাড়ি-ঘর, গাছ-পালা কয়েক হেক্টর আবাদী জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ভাঙ্গণের ঝুঁকিতে রয়েছে আরও কয়েক শত পরিবার।
মোগলহাট ইউনিয়নের কর্ণপুর, চরফলিমারী, খারুয়ায়, চওড়াটারী, কুরুল, চর খারুয়া ধরলা নদীর স্রোতের টানে তীব্রনদী ভাঙ্গণ দেখা দিয়েছে। এখানে ধরলা নদী ভারত হতে প্রবেশ করে বাংলাদেশে ঢুকেছে। কয়েক বছর আগেও এই নদী ভারতের ভূ-খন্ডের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুলাঘাটে বাংলাদেশের ভিতরে প্রবেশ করে ছিল। কিন্তু এখন নদী ভারত হতে সরে এসে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ধরলা নদীর তীব্র ভাঙ্গণে ধরলা নদীতে থাকা ভারতীয় রেল সেতুটি এখন নদীর মাঝখানে পড়ে গেছে। দুই ধার দিয়ে নদী প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে ভাঙ্গছে। বিশাল বিশাল ২টি গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে। চর ফলিমারী ধরলা নদীর মাঝখানে পড়ে গেছে। চারি ধার দিয়ে ধরলা নদী প্রবাহিত হচ্ছে। সেখানে একটি দ্বীপ সৃষ্টি হয়েছে। খারুয়া ও কর্ণপুরে ধরলা ভাঙ্গণে বাংলাদেশের মোগলহাট ও দূর্গাপুর ইউনিয়নের ভূ-খন্ড কমে আসছে। ভারতে জাগছে বিশাল বিশাল চর।
এদিকে চর গোকুন্ডা এলাকার ভাঙ্গণে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোর অভিযোগ শুষ্ক মৌসুমে একটি প্রভাবশালী চক্র তিস্তা নদীর ধারে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলন করে ছিল। ফলে বর্ষা মৌসুমে ওইসব স্থানে তিস্তা নদীতে তীব্র নদী ভাঙ্গণ দেখা দেয়। গোকুন্ডায় ডেজার মেশিন দিয়ে বালু তোলায় সেখানে একটি বাঁধের প্রায় ৫০মিটার ভেঙ্গে নদীর পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। রাতের আধাঁরে বাড়ি ঘর সারাতে গিয়ে বিদুতের তারে জড়িয়ে এক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়।
চর গোকুন্ডা এলাকার নদী ভাঙ্গণের শিকার মোরসেদা খাতুন (৩২) জানান, তার স্বামী সাইদুর ইসলাম ৮বছর আগে আরও একবার নদী ভাঙ্গণের শিকার হয়ে সবকিছু হারিয়ে স্ত্রী সন্তান নিয়ে নতুন করে সুখের সংসার গড়ে তুলছিলেন এখানে। কিন্তু তিস্তার ভাঙ্গা-গড়া খেলায় তাদের সুখ আর স্থায়ী হলো না। এই বছরে ভাঙ্গণে বাড়িরভিটাসহ আবাদী জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ায় তারা এখন নিঃস্ব।
কৃষক জাহের আলী (৬০) জানায়, ২দিন আগেও নিজেদের বসতভিটা ছিল, আবাদী জমি ও ফলের বাগান ছিল। সাধারণ ভাবে বেঁচে থাকার অবলম্বন ছিল। এখন আর কিছুই নেই। এখন আমরা নিঃস্ব-ভূমিহীন। পরিবার পরিজন নিয়ে থাকছি অনাহারে-অর্ধাহারে। এভাবেই দুঃখ-দুর্শা’র কথা জানিয়ে ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্থ শামীম (২৬), আছিম উদ্দিন (৬৭), নায়েব আলী (৫৫)সহ অনেকেই।
এলাকাবাসী ভাঙ্গণ প্রতিরোধে তিস্তা নদীর বাম তীরে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য সরকারের কাছে বিশেষ ভাবে অনুরোধ জানিয়েছে।
এ দিকে সমাজকর্মী ও নাট্যকার মাখন লাল দাশ (৬৫) তিস্তা নদী ভাঙ্গণ প্রতিরোধে তিস্তা নদী খনন করে পাথর দিয়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট দাবি জানিয়েছেন।
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আব্দুল কাদের জানান, তিস্তা ও ধরলা নদী ভাঙ্গণ কবলিত এলাকাগুলো পরিদর্শন করা হয়েছে। লালমনিরহাট সদর উপজেলায় সব থেকে বেশি ভাঙ্গণ কবলিত চর গোকুন্ডা এলাকায় ২শত মিটার নদী তীর ভাঙ্গণ প্রতিরোধে ৬৯লক্ষ টাকা ব্যায়ে অস্থায়ী ভাবে জিও ব্যাগ ফেলানোর বরাদ্দ পাওয়া গেছে। কয়েক দিনের মধ্যে কাজ শুরু করা হবে। এছাড়াও চওড়াটারী, কুরুল, চর খারুয়া এলাকায় ভাঙ্গণ রোধে কাজ শুরু করা হয়েছে। অন্যান্য এলাকার জন্য অনুমতি পেলেই ভাঙ্গণ রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মোগলহাট সীমান্তের নোম্যান্স ল্যান্ডে ধরলা নদী ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে ঢুকে পড়েছে। সেখানে আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী কাজ করতে হবে। তাই জিআরসির বৈঠকে অনুমোদন প্রয়োজন পড়বে। দুই দেশের যৌথ নদী কমিশনের পরামর্শ নিতে হবে। তবে ভাঙ্গ রোধে এখানে দুই দেশের জরুরী সিদ্ধান্তে পৌচ্ছতে হবে। তবে বাংলাদেশের ভূ-খন্ডে কাজ করতে কোন অসুবিধা নেই।
মোগলহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান হাবিব জানান, মোগলহাটের কর্ণপুর, চওড়াটারী, কুরুলে নদী ভাঙ্গণ মানে দেশের ভূ-খন্ড কমে যাওয়া। যেখানে দেশের সার্ভমৌমত্ব রক্ষায় প্রতিরক্ষা খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। সেখানে মোগলহাটে নদী ভাঙ্গণ রোধ করে ভূ-খন্ড বাঁচাতে জরুরী ভিত্তিতে প্রকল্প গ্রহণের দাবি জানান। সেই সাথে যেভাবে ধরলা নদী ধেয়ে আসছে। এভাবে চললে খুব শীঘ্রই শহরের পাশে ধরলা নদী চলে আসবে।
লালমনিরহাট সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান সুজন জানান, নদী ভাঙ্গণ এলাকা পরির্দশন করেছি। ভাঙ্গণ প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ জেলা প্রশাসকের নিকট পত্র দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও সরকারের পক্ষ থেকে ৬৮টি পরিবারের মাঝে নগদ অর্থ ও চাল বিতরণ করা হয়েছে।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি লালমনিরহাট জেলা শাখার তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক বিশিষ্ট সাংবাদিক মাসুদ রানা রাশেদ জানান, তিস্তা ও ধরলা পাড়ের মানুষকে নিয়ে জনপ্রতিনিধিরা রাজনীতি করেন। আর পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা শুকনো মৌসুমে কাজ না করে ভরা বর্ষায় সরকারি অর্থ লুট করার জন্য জিও ব্যাগ ফেলে লক্ষ লক্ষ টাকা হরিলুট করছে। এ থেকে পরিত্রাণ চায় তিস্তা ও ধরলা পাড়ের মানুষ।
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : অধ্যক্ষ মোঃ রবিউল ইসলাম মানিক
সম্পাদক : মোঃ মাসুদ রানা রাশেদ
প্রকাশক : মোঃ রমজান আলী
নির্বাহী সম্পাদক : মোঃ হেলাল হোসেন কবির
Copyright © 2024 আলোর মনি. All rights reserved.