তুষারপাত
টবিহান্না, পোকোনো পাইনস্, পোকোনো পর্বত, ফিলাডেলফিয়া।
গল্পটা কাছে থেকে দেখার অভিজ্ঞতার। জীবনে অনেকবার তুষারপাত এর সম্মুখীন হয়েছি, জমিনের ওপর ঝরে পড়ে থাকা তুষারের এক রূপ। সারারাত ধরে ঝরে পড়া তুষার সকালবেলা দেখার একধরনের তৃপ্তি। আর আকাশের ঘন গভীর মেঘ হতে সদ্য ঝরা তুষারপাত দুর থেকে দেখেছি,
ভেবেছি কতো নাজানি শীত হবে, কাছে যাইনি। কিন্তু পাতাহীন বৃক্ষের কালো কালো সব কান্ডের ওপর ধীরে জমে ওঠা তুষার
শুভ্রতার তুষারপাতে, পথে, মাঠে,
সাদার যে আনন্দ মিছিল, তাকে খুব কাছে থেকে দীর্ঘক্ষন বসে দেখার তেমন অবকাশ কখনো হয়নি।তবে বিজন পর্বতের কটেজে বসে, এ যে এক অন্যরকম আবেশ।
শীতলতার মাঝে,
জীবনের অনেক দৌড়ঝাঁপ
আছে ভাবতে পারিনি।
১০/৩/২৩ টিনটনফলস্ থেকে যখন রওনা হলাম,
আকাশের ভাব বোঝা দায় ছিলো। আবহাওয়া বার্তা তুষার ঝড়ের সংকেত দিয়ে যাচ্ছিলো, বরাবরের মতো।
যা হবার হবে। যাই তো আগে।
পোকোনো পর্বতের একটা কটেজের সামনে এসে কেবল দাঁড়ালাম, গাড়ী থেকে বের হবার পর,
আকাশ থেকে তুষার কণা একটা দুটো করে ভেসে শরীরে মাথায় পড়ছিলো।
শুরু হলো কিন্তু তারপর অবিরাম রাত এগারো বারোটা পর্যন্ত বিশাল কাঁচের জানালার পাশে বসেই থাকলাম।
তুষার পাত হয়ে যাবার পর সকালে সাদা পৃথিবীর রূপ দেখেছি প্রান ভরে, কিন্তু তুষারপাত কাছে বসে অবলোকন করা,
দীর্ঘ সময় ধরে এবারই প্রথম।
কবে অনেকদিন আগে, কোন এক বৃষ্টি ঝরা বিকেলে,
মিলিতা কে পড়া দেখাতে যেয়ে, বৃষ্টি দেখছিলাম, সেই আমলকি গাছ, সেই ছোট্ট খেলার মাঠ, সামনের মাঠের ওপাশের রেইনট্রি , অনেক উঁচু গাছটা মনে হচ্ছিলো বৃষ্টির দাপটে ঝুলে নেমে আসছে
মাটির কাছাকাছি-
কি মনে হচ্ছে, প্রশ্ন শুনে পিছন ফিরে তাকাই,মিলিতা দাঁড়িয়ে, পড়াবেন না।
ঝড়ঝড় বৃষ্টির শব্দের মাঝে মন এলোমেলো হয়ে যায়। নাহ আজ পড়বার দিন নয়।
মনে হয় ভিজে ভিজে বাড়ী চলে যাই।
বলেই বৃষ্টিতে নেমে হাঁটতে শুরু করলাম।
তোমার চোখে একটা বিষ্ময় ছড়িয়ে যাচ্ছিলো। হেঁটে যেতে যেতে মনে হলো বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম এর আগে ১৯৬৭ তে। তেমন অনুভব এবার নেই।
এবার বারবার করে পিছন ফিরে তাকাতে মন চাইছে।
মানুষ কতোটা স্মৃতিভূক হলে এমন করে তুষার পাতের মাঝে পন্চাশ বছর আগের কথা,
একটু একটু করে জীর্ণ খাতার পাতায় হারিয়ে যাওয়া অক্ষরের মতোন
স্মৃতির পাতায়, হাতড়ে দেখতে পায়।
তুষার পাতের বাস্তবতায় ফিরে আসি।
এর মধ্যে রেলিং এর ওপর এক ইঞ্চির মতো জমে গেছে।
গাছের কালো ডাল গুলো ওপরে সাদা, নীচে কালো ডালের অস্তিত্ব। অনেকক্ষন হয়ে গেছে। বসেই আছি। এর মধ্যে আভা আর শেলী দুজনের রান্না করা খিচুড়ী ডিম ভুনা তারপর চা খেয়ে, সন্ধ্যা নেমে এসেছে।
দুপুরে রেষ্ট নিলাম না। সারা জীবন তো কতোই ঘুমিয়ে কাটালাম, আজ একেবারে দশ ফুট দুরে তুষার পাত, বনভূমির ভেতরে কটেজে বসে,
জীবনের সব পথে পথে হেঁটে বেড়ানোর স্মৃতি একসাথে মাথার মধ্যে দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করলো।
বিদ্যুতের আলোয় ঝকঝক করছিলো, সমস্ত তুষার গুলো।
বন এতো সুন্দর অন্ধকারে ঝকঝক করে ওঠে বিশ্বাস করতে পারতাম না নিজের চোখে কাছে থেকে না দেখলে।
মনটা কেমন যেনো শুধু পিছনের পানে ফিরে যেতে চায়।
জীবনের কথা মনে হয়। কতো কিছু যে দেখলাম। একজন মানুষের হাজার বছরের আয়ু নিয়ে জন্মালে, পথে পথে ঘুরে এ দেখার শেষ হবে না।
রবীন স্যার সেই ১৯৯৬ সালের জুলাই মাসে চলে গেছেন।
আংগুলে গুনে শেষ হয় না বছরের হিসাব। ছাব্বিশ বছর। ওনার কবরের পাশে মোটা একটা মেহগনি গাছ, লোভী মানুষের চোখে পড়লেই, কেটে ফেলতে চাইবে।
স্যার এতো একজন কঠিন নিয়মের মানুষ ছিলেন।
আমার খালু নুর হোসেন মাষ্টার, রবীন স্যারের স্মরন সভায় বলেছিলেন,
“ওনার হাঁটা দেখলে মনে হতো, কি একটা জরুরী কাজ করার বাকী আছে, তাই তাড়াহুড়া করে যাচ্ছেন।”
কি দারুন উপমা।
একজন কর্মবীর মানুষের উপমা এমন করে ন্যুনতম শব্দের ব্যবহার করে দেয়া যায়, ভাবতে পারিনি।
তিনিও দুরাকুটি স্কুলের হেড মাষ্টার ছিলেন।
সারা জীবন ছাত্র মানুষ করার পিছনে, যে শ্রম ও সাধনা দিয়ে গেছেন,
তার প্রতিদান পেয়েছেন, নিজের তিন শিক্ষিত সন্তানের মাঝ দিয়ে।
বাংলাদেশে বেশী সার্থক হবার দরকার নাই। একটা সুন্দর পরিবার পেলে, নিজের কর্ম নিয়ে ভালো থাকতে পারলেই যথেষ্ট।
সেই সব মানুষেরা যারা আমাদের পথ দেখিয়েছেন, তাঁরা কেউ নেই।
আমরাই আজ সংসার সীমান্তে এসে দাঁড়িয়ে আছি। প্রতিদিন শুধু ঝড়ে পড়ার খবর পাই।
২০/৩/২৩, টিনটনফলস্,
নিউজার্সি,
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : অধ্যক্ষ মোঃ রবিউল ইসলাম মানিক
সম্পাদক : মোঃ মাসুদ রানা রাশেদ
প্রকাশক : মোঃ রমজান আলী
নির্বাহী সম্পাদক : মোঃ হেলাল হোসেন কবির
Copyright © 2024 আলোর মনি. All rights reserved.