লালমনিরহাটে থেকে ৭১-এর খোঁজে নদী যাত্রা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
শুক্রবার (৪ নভেম্বর) সকাল ১১টায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন লালমনিরহাটের মোগলহাটস্থ ধরলা নদী হতে তিস্তা, বহ্মপুত্র, যমুনা নদী হয়ে বঙ্গবন্ধু সেতুতে গিয়ে এ নদী যাত্রা শেষ হবে।
ধরলা নদীর পাড়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনায় বক্তব্য রাখেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. আনোয়ার হোসেন প্রমুখ। এ সময় জাতীয় যুব জোট কেন্দ্রীয় কমিটির সহসম্পাদক আজমুল হক পুতুল, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি কামাল আনিছুজ্জামান রবিন, একাত্তর টিভি প্রতিনিধি উত্তম কুমার রায়, সাপ্তাহিক আলোর মনি পত্রিকার সম্পাদক মোঃ মাসুদ রানা রাশেদসহ অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।
৭১-এর খোঁজে নদী যাত্রায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, একটি স্বপ্নের কথা প্রথমে বলে নেই। আমাদের ভাই-বোনদের সেই স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। আমাদের ভাই কর্ণেল আবু তাহের বীর উত্তম। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের উত্তর রণাঙ্গনে ১১ নম্বর সেক্টরে আমরা সব ভাই-বোন সেক্টর কম্যান্ডার তাহেরের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে সামিল হয়েছি। সেই সময় একদিন তিনি আমাদের বলেন, যদি এই যুদ্ধে বেঁচে থাকি তা হলে জীবনে অন্তত একবার স্বাধীন বাংলাদেশের উত্তর সীমান্ত দিয়ে যেসব নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, তার একটি ধরে নৌকায় যাত্রা শুরু করবে। নানা নদী বেয়ে যাত্রা শেষ করবে বঙ্গোপসাগরে। যাত্রাপথে গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখবে অপরূপ সোনার বাংলার ছবি। কথা বলবে বাংলার সাধারণ মানুষের সাথে। তাঁদের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাংখার কথা। সাধারণ কৃষক মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবারের কথা শুনবে। একই সাথে সেই সব অসহায় নারী-পুরুষ, নিজেদের রক্ষা করবার জন্য যাঁদের হাতে অস্ত্র ছিলনা, কিন্তু তারপরও যারা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে, নিজেরা না খেয়ে তাদের খাবার দিয়েছে, শত্রুদের নিখুঁত অবস্থান বলে দিয়েছে, পরিনামে অকাতরে যাঁদের জীবন দিতে হয়েছে, কত মা-বোনেরা ধর্ষিত হয়েছে- সেই সব বিপন্ন মানুষজনদের বীরত্বগাঁথা, দুঃখ-বেদনার কথা শুনবে। গ্রাম-বাংলার দরিদ্র মানুষের নানা সমস্যা এবং তা সমাধানে তাঁদের ভাবনা জানতে চাইবে। তারপর কত বছর পেরিয়ে গেছে। নানা ঝড়-ঝঞ্জাা বয়ে গেছে আমাদের জীবনে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতা, তাহেরসহ কত মুক্তিযোদ্ধা, অসহায় মানুষ যাঁদের কথা তাহের আমাদের বলতেন, তাঁদের আমরা হারিয়ে ফেলেছি অসময়ে। স্বপ্নপূরণ করতে পারিনি। কিন্তু স্বপ্নকে হারিয়েও যেতে দেইনি।
গত আগস্টে আমার বয়স ৭৬ পেরিয়ে গেছে। ভেবে দেখলাম আর দেরী নয়। লালমনিহাটের মোগলহাটে ভারত থেকে প্রবেশ করেছে ধরলা নদী। গত শীতের আগে সেখানে গিয়ে জানলাম রংপুরের বিপ্লবী কৃষক নেতা নুরলদিন যিনি তার কৃষক গণবাহিনী নিয়ে ইংরেজ বাহিনী এবং ব্রিটিশের তাবেদার জমিদারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই করেছেন, তিনি ঘাঁটি গেড়েছিলেন এই মোগলহাটে। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের অমর সৃষ্টি ‘নূরनদিনের সারা জীবন’ কাব্যনাট্যের নায়ক নূরলদিনের উদাত্ত ডাক ‘জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়’ বাংলার বিপন্ন কৃষক জনসাধারণকে আন্দোলিত করতে থাকবে অনাগতকাল ধরে। মুহূর্তে সেসব মনে পড়লো। তখনই স্থির করে ফেলেছি এই মোগলহাটের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ধরলা নদী দিয়েই আমাদের যাত্রা শুরু হবে। একাত্তরে নদী ও নৌকা ছিল বিপন্ন মানুষের বেঁচে থাকার ভরসা। মুক্তিযোদ্ধাদের বাহনও ছিল নৌকা। অন্যদিকে নদী ও নৌকাকে ভয় পেয়েছে হানাদার বাহিনী। আজ ৪ নভেম্বর, ২০২২ তারিখে একটি দেশী নৌকায় আমরা স্বপ্নযাত্রা শুরু করবো।
ধরলা হয়ে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, তার সাথে যুক্ত হয়ে যমুনা ধরে আমাদের নৌকা চলবে। এবারের মত শেষ হবে বঙ্গবন্ধু সেতুর নিচে। যদি বেঁচে থাকি, আগামী বছর ২০২৩ সালের এমন সময়ে সেখান থেকে আবার যাত্রা শুরু হবে। নৌকা চলবে যমুনা ধরে, রাজবাড়ী জেলার দৌলতদিয়ায় মিলিত হবে পদ্মায়। পদ্মা বেয়ে নৌকা এগুবে। চাঁদপুরে মিলিত হবে মেঘনা নদীতে। শেষ নদী মেঘনা হয়ে আমরা যাব হাতিয়ায় বিশাল বঙ্গোপসাগরের মোহনায়।
‘৭১-এর খোঁজে নদী যাত্রা’- এই শিরোনামটি প্রস্তাব করেছিলেন লালমনিরহাটের ‘প্রথম আলোর’ সংবাদদাতা আব্দুর রব সুজন। ৭১-এর জনযুদ্ধে গ্রাম বাংলার জনসাধারণ যারা সবচেয়ে বেশী আত্মত্যাগ করেছেন, বিনিময়ে তেমন কিছুই পাননি, তাঁদের কথা শুনতে এই নদীযাত্রার কথাইতো বলেছিলেন কর্নেল আবু তাহের, বীর উত্তম। স্বাধীন বাংলায় যথন ফাঁসির মঞ্চে তিনি দাঁড়িয়েছেন, তখনও কারাগারের উঁচু দেয়াল অতিক্রম করে বিপ্লবী তাহেরের স্বপ্নময় দৃষ্টি বাংলার নদী, মাঠ ও বঞ্চিত-নিপীড়িত দরিদ্র জনসাধারণের উপর পড়েছিল, যাঁদের মুক্তির জন্য অকাতরে তিনি জীবন উৎসর্গ করলেন। স্বাধীনতার ৫০বছর পরেও তাই ৭১-এর খোঁজে নদী যাত্রায় আমরা সামিল হয়েছি। চলতে চলতে আমরা থামবো, কথা বলবো সেই সব মানুষের সাথে যাঁদের কথা অনেকেরই হয়তো বহুদিন শোনা হয়নি। আমরা তা আপনাদের জানাতে থাকবো।
এবারের যাত্রায় আমার সাথে সামিল হয়েছেন বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের সহকারী পরিচালক মোগলহাটের কৃতিসন্তান মোঃ ফেরদৌস আলম। বলতে গেলে নদীযাত্রায় অংশ নিতে তাঁর প্রবল উৎসাহ এবং বিপুল কর্মোদ্যোগে আমাদের বহুদিনের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পাচ্ছে। আরও যুক্ত হয়েছেন নদীকে ভালবাসেন, গ্রামের কৃষকদের সাথে গভীর নৈকট্য আছে এমন দুজন সালাহউদ্দিন রাজ্জাক রানা এবং জিয়াউদ্দিন রাজ্জাক অপু। চির বিপ্লবী সৈয়দ বাহারুল হাসান সবুজ আছেন আমাদের সাথে।
কুড়িগ্রামের শিমূলবাড়ির ওবায়দুল হক ও মাহাবুল হক আমাদের দেশি নৌকার মাঝি হিসেবে আমাদের সাথে থাকবেন পুরো যাত্রায়।
পরের যাত্রা যদি কোন কারণে সম্পন্ন করতে অপারগ হই, তাতে দুঃখ করবো না। আমি জানি নতুন প্রজন্মের কেউ না কেউ তা সম্পন্ন করবে।