আলোর মনি রিপোর্ট: শিশুটির সারা শরীরে অসংখ্য কালসিটে দাগ। কোনো আঘাতের চিহ্ন নতুন, কোনোটা পুরোনো। তাকে দিয়ে করানো হতো ভারী কাজ। পান থেকে চুন খসলেই পেটানো হতো। কখনও সুপারী কাটার সর্তা দিয়ে সারা শরীরে আঘাত করত গৃহকর্ত্রী। দিনের পর দিন এভাবে অমানবিক নির্যাতন চলত গৃহপরিচারিকা এই শিশুটির ওপর। নির্যাতনের পাশাপাশি দিনের বেশির ভাগ সময় তাকে কোনো খাবার দেওয়া হতো না। দিন শেষে রাতের বেলা মিলত সামান্য ভাত। তবে জুটত না কোনো তরকারি।
দিনমজুর বাবার ৭বছরের শিশু সন্তান হাসিনা বেগম। সারা শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন নিয়ে লালমনিরহাট সদর হাসপাতালের তৃতীয় তলায় সার্জারী ওয়ার্ডের বিছানায় ব্যথায় কাতরাচ্ছে শিশুটি। ঢাকায় এক পুলিশ কর্মকর্তার বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ করতে গিয়ে শিশুটি নির্মম শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ। গত রোববার (২৯ আগস্ট) রাতে তাকে লালমনিরহাট সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
শিশুটির নির্যাতনের বিচার পাওয়া নিয়ে দিনমজুর পরিবারটির সংশয় রয়েছে। এর আগে রোববার (২৯ আগস্ট) সকালে পুলিশ কর্মকর্তার লোকজন হাসিনাকে ঢাকা থেকে লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী উপজেলার ভেলাবাড়ী ইউনিয়নের মহিষতলী গ্রামে তার নানির বাড়িতে রেখে যায়। এ সময় স্থানীয়রা মেয়েটির সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেয়ে তাকে লালমনিরহাট সদর হাসপাতালে ভর্তি করান।
জানা যায়, দিনমজুর হাসান আলী ও রহিমা দম্পতির ২কন্যা সন্তানের মধ্যে বড় হাসিনা বেগম। স্বামী হাসান আলীর পিটুনিতে রহিমা অসুস্থ হয়ে পড়লে নানি আমেনা বেগম বড় নাতনি হাসিনাকে মহিষতলীতে নিয়ে আসেন। বছর খানেক আগে একই গ্রামের বাসিন্দা নরসিংদী জেলার পুলিশ পরিদর্শক আজহার আলী সুমন বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে হাসিনাকে ঢাকায় তার বাড়িতে নিয়ে যান। তার এই কাজে সহায়তা করে সুমনের বড় বোন মানিকজান। দীর্ঘ ১বছর পর রোববার (২৯ আগস্ট) সকালে গাড়িতে করে অসুস্থ হাসিনাকে মহিষতলী এলাকায় রেখে যায় পুলিশ কর্মকর্তার লোকজন। গাড়ি থেকে নেমে হাসিনা ঠিকমতো হাঁটতে না পারায় সন্দেহ হয় স্থানীয়দের। পরে এলাকার লোকজন মেয়েটির শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন দেখতে পান।
লালমনিরহাট সদর হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে শিশু হাসিনা বেগম। সে জানায়, তাকে দিয়ে ভারী কাজ করানো হতো। ঠিকমতো কাজ করতে না পারলে সুপারী কাটার সর্তা দিয়ে সারা শরীরে আঘাত করত গৃহকর্ত্রী ডেইজি। দিনের অধিকাংশ সময় না খেয়ে কাটত তার। রাতের বেলা সামান্য ভাতে তরকারির বদলে জুটত শুধু সরিষার তেল।
মা রহিমা বেগম জানান, অভাবের তাড়নায় তার মেয়েকে পুলিশ কর্মকর্তা সুমনকে দিয়েছিলেন। সুমন বলেছিলেন হাসিনাকে লেখাপড়া শিখিয়ে বিয়ে দেওয়া হবে। এখন দেখছেন নির্যাতনে বাচ্চাটাই তার শেষ।
হাসিনার নানি আমেনা বেগম বলেন, আদিতমারী পুলিশ অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তার ঠিকানা সঠিকভাবে লিখে অভিযোগ করতে বলেছেন।
অভিযুক্ত সুমনের বড় বোন মানিকজান শিশু নির্যাতনের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তিনি জানান, মোবাইল ফোনে সুমন তাকে জানিয়েছেন কেউ তার কিছুই করতে পারবে না।
তবে শিশু গৃহপরিচারিকাকে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পুলিশ কর্মকর্তা আজহার আলী সুমন। তার দাবি, অসুস্থ ও শরীরে ঘা-পাঁচড়া থাকা অবস্থায় শিশু হাসিনাকে তার কাছে আনা হয়েছিল। তিনি আদর-যত্ন করে হাসিনাকে সুস্থ করে তুলেছেন। তাকে বিপদে ফেলতে এসব করা হচ্ছে বলে দাবি করে তিনি জানান, নরসিংদী জেলায় পুলিশ পরিদর্শক পদে তিনি কর্মরত।
আদিতমারী থানার অফিসার ইনচার্জ সাইফুর ইসলাম বলেন, এ বিষয়ে তার সঙ্গে কেউ দেখা করেনি এবং তিনি কোনো অভিযোগ পাননি।
লালমনিরহাট সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক মনজুর মোর্শেদ দোলন বলেন, হাসিনা দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তার শরীর পরীক্ষা করে অনেক আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। তার চিকিৎসা চলছে বলে তিনি জানান।