৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর লালমনিরহাট রেল বিভাগে ২০৮টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ। ৬একর ৩শতক জমি উদ্ধার। আওয়ামী লীগের এমপি, পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন ও মদদপুষ্টরা জবর দখলে ছিলেন।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তৎকালীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিপ্লবী ছাত্র জনতার বৈষম্য বিরোধী ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন।
৫ আগস্টের পর লালমনিরহাট রেলওয়ে বিভাগের বিভিন্ন স্থানের ২০৮টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে জবর দখল হওয়া ৬একর ৩শতক রেলওয়ে ভূসম্পত্তি উদ্ধার করা হয়।
এর আগে এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে জবর দখল হওয়া এই জমি উদ্ধার করতে পারেনি রেলওয়ে ভূসম্পত্তি বিভাগের কর্মকর্তাগণ। বরং উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে বাধার মুখে ফিরে আসে রেলওয়ে ভূসম্পত্তি কার্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের।
মূল্যবান ৬একর ৩শতক রেলওয়ে ভূসম্পত্তি উদ্ধারের আগ পর্যন্ত তৎকালীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এমপি, মন্ত্রী, পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনসহ তাদের মদদপুষ্টরা জবর দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করে ভোগ দখল করে আসছিলেন।
বাংলাদেশ রেলওয়ে লালমনিরহাট বিভাগীয় ভূসম্পত্তি কর্মকর্তার দপ্তর সার্বিক বিষয়টি নিশ্চিত করে।
লালমনিরহাট রেলওয়ে বিভাগীয় ভূসম্পত্তি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ১৯ আগস্ট লালমনিরহাট রেল স্টেশন এলাকায় একটি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে ২শতক রেলওয়ে ভূসম্পত্তি, ২২ আগস্ট দিনাজপুরে ২০টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে ১৬শতক রেলওয়ে ভূসম্পত্তি, ২৯ আগস্ট বগুড়ায় ৩টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে ৪শতক রেলওয়ে ভূসম্পত্তি উদ্ধার করা হয়।
এরপর ১০ সেপ্টেম্বর কুড়িগ্রামে ৩টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে ৬শতক রেলওয়ে ভূসম্পত্তি উদ্ধার হয়, ১২ সেপ্টেম্বর লালমনিরহাটে একটি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে ৩শতক রেলওয়ে ভূসম্পত্তি উদ্ধার হয়, ১৮ সেপ্টেম্বর লালমনিরহাটের তুষভান্ডারে একটি জলাশয় অবৈধ দখল মুক্ত করে ৫১শতক রেলওয়ে ভূসম্পত্তি উদ্ধার হয়। ২২ সেপ্টেম্বর কুড়িগ্রামের একটি জলাশয় অবৈধ দখল মুক্ত করে ৮০শতক রেলওয়ে ভূসম্পত্তি উদ্ধার হয়।
এরপর ২০২৪ সালের ২১ অক্টোবর গাইবান্ধায় ৫টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে ১০শতক রেলওয়ে ভূসম্পত্তি উদ্ধার হয়, ২৩ অক্টোবর লালমনিরহাটের ৩টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে ১১শতক রেলওয়ে ভূসম্পত্তি উদ্ধার হয়, ২৪ অক্টোবর গাইবান্ধার ভরতখালিতে ৪টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে ৩০শতক রেলওয়ে ভূসম্পত্তি উদ্ধার হয়, ২৯ অক্টোবর ঠাকুরগাঁও এ ৯০টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে ৪৫শতক রেলওয়ে ভূসম্পত্তি উদ্ধার হয়।
একই সালের ১৮ এবং ১৯ নভেম্বর লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের তুষভান্ডারে ৮টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে ১একর ৫৭শতক রেলওয়ে ভূসম্পত্তি উদ্ধার হয়।
একই সালের ১৭ ডিসেম্বর রংপুরের কাউনিয়ায় ৭টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে ৩৫শতক রেলওয়ে ভূসম্পত্তি উদ্ধার হয়, ২৩ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামের রাজারহাটে ১৬টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে ৫৩শতক রেলওয়ে ভূসম্পত্তি উদ্ধার হয়, ২৬ ডিসেম্বর গাইবান্ধার বাদিয়াখালিতে ৬টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে ৫০শতক রেলওয়ে ভূসম্পত্তি উদ্ধার হয়।
এরপর ২০২৫ সালের ১২ জানুয়ারি লালমনিরহাট শহরের মোগলহাট রেল গেট এলাকায় ৪০টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে ৫০শতক রেলওয়ে ভূসম্পত্তি উদ্ধার হয়।
৫ আগস্টের পর উচ্ছেদ হওয়া লালমনিরহাটের বহুল আলোচিত ৩টি পৃথক উচ্ছেদ অভিযানের মধ্যে রয়েছে শহরের বিডিআর রোডস্থ বসুন্ধরা মার্কেট এলাকার একটি উচ্ছেদ অভিযান, লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের তুষভান্ডার রেল স্টেশন এলাকার উচ্ছেদ অভিযান এবং লালমনিরহাট শহরের মোগলহাট রেল গেট এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান।
চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি লালমনিরহাট শহরের মোগলহাট রেল গেট এলাকায় তৎকালীন লালমনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক (সাবেক লালমনিরহাট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি) জহুরুল হক ওরফে মামুনের এবং মামুনের মৃত্যুর পরবর্তী সময়ে তার পরিবারের সদস্যদের জবর দখলে থাকা অবৈধভাবে নির্মিত একটি আলিসান মার্কেট (১৫টি দোকান) উচ্ছেদ করা হয়। একই দিন মামুনের মার্কেট সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত আরও ২৫টি অবৈধ স্থাপনা (ফলের দোকানসহ অন্যান্য দোকান) অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে ৫০শতক রেলওয়ে ভূসম্পত্তি উদ্ধার হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর লালমনিরহাট শহরের মোগলহাট রেল গেট এলাকায় তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা জহুরুল হক ওরফে মামুনের নেতৃত্বে রেলওয়ে ভূসম্পত্তি জবর দখল করে একটি আলিসান মার্কেট তৈরি করে ভাড়া দেওয়া হয়। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রেলওয়ে ভূসম্পত্তি কার্যালয়ের কর্মকর্তাগণ কয়েকবার অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করতে সংশ্লিষ্টদের নোটিশ দিলেও কখনো উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতে পারেনি নানান সীমাবদ্ধতা ও বাধার মুখে।
৫ আগস্টের পর রেলওয়ে ভূসম্পত্তি কার্যালয়ের সব চেয়ে আলোচিত উচ্ছেদ অভিযান হচ্ছে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের তুষভান্ডার রেল স্টেশন এলাকার উচ্ছেদ অভিযান।
২০২৪ সালের ১৮ নভেম্বর লালমনিরহাট-২ (আদিতমারী-কালীগঞ্জ) আসনের সাবেক এমপি ও সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ ও তার স্বজনদের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে, আনুমানিক ৫শতক রেলওয়ে ভূসম্পত্তিতে কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়, সাবেক এমপি ও সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের নামে অস্থায়ী কৃষি লাইসেন্সের আওতায় থাকা ৩৬শতক রেলওয়ে ভূসম্পত্তিতে তার ছেলে, লালমনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিবুজ্জামান আহমেদের সুইমিংপুল কাম পার্ক, কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের ছোট ভাই শামসুজ্জামান আহমেদ ওরফে ভুট্টাের নামে অস্থায়ী কৃষি লাইসেন্সের আওতায় থাকা রেলওয়ের ৭০শতক রেলওয়ে ভূসম্পত্তিতে অবৈধভাবে নির্মাণাধীন স্থাপনা ও নুরুজ্জামান আহমেদের প্রভাবখাটিয়ে নেওয়া বাণিজ্যিক লাইসেন্সের আওতায় আনুমানিক ১০শতক রেলওয়ে ভূসম্পত্তিতে (মাষ্টার প্ল্যান বহির্ভূত হওয়ায় অবৈধ) অবৈধ ভাবে নির্মিত একটি তামাকের গোডাউন। এর আগে নুরুজ্জামান আহমেদের অস্থায়ী কৃষি লাইসেন্স বাতিল করা হয়।
এখানে উল্লেখ যে, এর আগে ২০২২ সালে একবার লালমনিরহাট রেলওয়ে ভূসম্পত্তি কার্যালয়ের কর্মকর্তাগণ তুষভান্ডার রেল স্টেশন এলাকায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতে যান। সে সময় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ও এমপি নুরুজ্জামান আহমেদের ক্ষমতার দাপটে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা না করেই ফিরে আসে।
আলোচিত আরেকটি উচ্ছেদ অভিযান হলো লালমনিরহাট শহরের বিডিআর রোডস্থ বসুন্ধরা মার্কেট এলাকায় অবৈধভাবে নির্মিত শরীফ মোঃ আতাউল্লাহ সরকারের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান।
২০২৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর এ উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়। এর আগে একই সালের ২ জুলাই এক হাজার বর্গফুট জায়গায় নির্মিত আধাপাকা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে যায় লালমনিরহাট রেলওয়ে ভূসম্পত্তি বিভাগ। কিন্তু লালমনিরহাট-৩ সদর আসনের তৎকালীন এমপি ও লালমনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোঃ মতিয়ার রহমানের টেলিফোনিক হস্তক্ষেপ এবং তৎকালীন এমপি মতিয়ার রহমানের ঘনিষ্ঠ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন ওরফে সুমন খান এবং লালমনিরহাট জেলা যুবলীগের সভাপতি মোড়ল হুমায়ুন কবীরের উপস্থিতি ও প্রভাবখাটানোর দরুন উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা না করেই ফিরে আসতে হয় রেলওয়ে ভূসম্পত্তি কর্মকর্তাগণসহ অন্যদের।
লালমনিরহাট বিভাগীয় রেলওয়ে ভূসম্পত্তি কার্যালয়ের সহকারী ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা মোঃ আবদুর রাজ্জাক ও একই কার্যালয়ের কানুনগো শেখ মঞ্জুরুল হক এক প্রশ্নের জবাবে সার্বিক বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার ৫ আগষ্টের গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত না হলে, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন না হলে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে না গেলে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা ও তাদের মদদপুষ্টদের জবর দখলে থাকা লালমনিরহাট রেল বিভাগের ছয় একর ৩শতক রেলওয়ে ভূসম্পত্তি উদ্ধার এবং ২০৮টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা সম্ভব হতো কি না তা নিয়ে আমাদের মনেও প্রশ্ন রয়েছে। কারণ সেই সময়ের পরিস্থিতি উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করার অনুকূলে ছিলো না। বাধা দানের অনেক ঘটনা ছিলো।