লালমনিরহাটে ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ এই প্রবাদটি সেই হাজার বছরের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পরিচয় বহন করে। এরই ধারাবাহিকতায় আদি কাল থেকে মাছ ধরার নানা পদ্ধতি চালু আছে আমাদের এ দেশ তথা জেলায়। লালমনিরহাটের গ্রামীণ জীবনের পথে-প্রান্তরে সে সব বৈচিত্রের দেখা মেলে। নদীমাতৃক জীবনাচারে জেলের মাছ ধরার পদ্ধতি নাগরিক জীবনকে ঘোরের মধ্যে ফেলে দেবে।
মাছ ধরার প্রাচীণ পদ্ধতির একটি হলো কাঠাল দিয়ে মাছ শিকার। এই পদ্ধতিতে নদী-নালা, খাল-বিল, ডোবা বা পুকুরে প্রথমে গাছের ডালপালা, বাঁশ-বাঁশের আগালি দেওয়া হয়। তারপর কচুরিপানা দিয়ে সে জায়গা ঢেকে দেওয়া হয়। ফলে সেখানে আর অন্য কারও মাছ ধরার নিয়ম থাকে না। কাঠাল হিসেবে সবচেয়ে কার্যকর তেতুল গাছের ডালপালা ও বড় বাঁশ-বাঁশের আগালি। এই গাছের ডাল ও বাঁশের আগালি দিয়ে কাঠাল দিলে মাছ বেশি পাওয়া যায়। বর্তমানে তেতুলের ডাল পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। আবার দামও বেশি। কিন্তু বাঁশ ও বাঁশের আগালি অত্যন্ত সহজলভ্য। তাই এর ব্যবহার বেশি হচ্ছে বর্তমানে।
কাঠাল ও কচুরিপানা দিয়ে ঘের তৈরি করার পর সেখানে বস্তাবন্দি করে খাবার দেওয়া হয়। খাবারের ঘ্রাণে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ আসে। মাছ এই জায়গাটাকে নিরাপদ মনে করে। যেন তার অভয়ারণ্য। ধীরে ধীরে ঘের থেকে পানি কমতে থাকে। মাছের ঘনত্ব বাড়তে থাকে। নির্দিষ্ট সময়ের পর কাঠাল থেকে মাছ সংগ্রহ করা হয়ে থাকে।
মাছ ধরার কাঠালীরা জানান, আমরা নদীর খালগুলোতে গাছের ডাল ও বাঁশ-বাঁশের আগালি এবং কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে দিই, যাতে কেউ মাছ মারতে না পারে। মাছকে আকৃষ্ট করতে পর্যাপ্ত খাবার বাঁশের সঙ্গে বস্তা দিয়ে বেঁধে দিই।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বর্তমানে প্রায় লোকই বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ করে। কাঠাল দিয়ে মাছ শিকারের দৃশ্য এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। সেই জলাশয়, বিল আর ডোবাগুলোই তো হারিয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। একদিন হয়তো কাঠাল দিয়ে মাছ শিকারের ব্যাপারটিও হারিয়ে যাবে। কিন্তু না হারিয়ে যায়নি। এর ঐতিহ্য ধরে রেখেছে লালমনিরহাটের মোগলহাট ইউনিয়নের কোদালখাতা ও কুলাঘাট ইউনিয়নের বনগ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া রত্নাই নদীর পাড়ের মানুষেরা। এ নদীতে মাছ ধরার কাঠাল দেওয়ার দৃশ্য হর হামেশাই চোখে পড়ে।
এছাড়াও লালমনিরহাট জেলার তিস্তা, ধরলা, রত্নাই, স্বর্ণামতি, শিংগীমারী, সানিয়াজান, ত্রিমোহনী, সাকোয়া, মরাসতি, ধোলাই, গিদারী, ছিনাকাটা নদীগুলোতে মাছ ধরার কাঠাল দিয়ে মাছ আহরণ করতে দেখা গেছে।