শিরোনাম :
সাপ্তাহিক আলোর মনি পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে আপনাকে স্বাগতম। # সারাবিশ্বের সর্বশেষ সংবাদ পড়তে আমাদের সঙ্গেই থাকুন। -ধন্যবাদ।
শিরোনাম :
গণতন্ত্র আমাদের হাতের নাগালে নাই-লালমনিরহাটে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায় লালমনিরহাটে বিনামূল্যে চক্ষু চিকিৎসা ও ঔষধ সেবা অর্ধেক মূল্যে হত দরিদ্রদের ছানি অপারেশন অরবিট চক্ষু হাসপাতালে লালমনিরহাটে শীতের হরেক রকমের পিঠার দোকানের পসরা নিয়ে বসছেন বিক্রেতারা বিএনপির কর্মী সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত বাবা-মাকে একটা বাড়ি করে দেওয়ার স্বপ্ন যেন চিরতরে হারিয়ে গেলো লালমনিরহাটের শহীদ শাহিনুর আলমের বিএনপির কর্মী সভা অনুষ্ঠিত যতদিন নির্বাচন হবে না, ততদিন স্বাভাবিক অবস্থায় দেশে ফিরে আসবেনা-অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু আলু চাষ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন লালমনিরহাটের কৃষকেরা লালমনিরহাটে সরকার ফার্মেসী এর শুভ উদ্বোধন অনুষ্ঠিত লালমনিরহাটে খাদ্য বান্ধব কর্মসূচি (জিআর) চাল কালোবাজারে বিক্রির অভিযোগ

পাগলের ইতিবৃত্ত আর ডাকু মামা

:: টেবিল টক ::
-জাকি ফারুকী::
স্বাধীনতা পূর্বকালের পাকিস্তানী সময়ে, লালমনিরহাটে দুটো পাগল ছিলো।
একজন পাগল পুরোপুরি বস্ত্রহীন সবখানে চলাচল করতো।
গ্রীস্মে সম্পূর্ন দিগম্বর, আর শীতে কোন মানুষের বদান্যতায় দেয়া একটা চট, ঘাড়ের ওপর দিয়ে ঝোলানো, হাতের নখ গুলো বড়, গায়ে মাটি মাখা।
যখনি দেখা পেতাম, এই পাগলকে আমার খুবই বিস্ময়কর মনে হতো। বিড়বিড় করে ঠোঁট নেড়ে সারাক্ষন কি বলতো, সেই জানে।
যখন যে এলাকায় থাকতো, একাধারে কারো বাইরের বারান্দায়, সেখানে নানান কাহিনীর জন্ম হতো। এই নেংটা পাগলা, সবার কাছে খাবার নিতো না, অথবা খেতো না।
কোন বাসার সামনে গেলে, তাঁকে অনের উপাদেয় খাবার দিলেও, হাত না দিয়ে চলে যেতো। আবার কারো হাতে খাবার সব সময় গ্রহণ করতো।
তাঁকে চুল দাড়ি বেশী জট পাকিয়ে গেলে অনেক নাপিতরা যত্ন করে কেটে দিতো। নাদুস নুদুস দোহারা চেহারার এই পাগলাকে নিয়ে জনশ্রুতি নানান রকম ছিলো।
১৯৭১ এর যুদ্ধ শেষে সব বিহারীরা যখন লালমনিরহাট ছেড়ে চলে যায়, নেংটা পাগলা, কিন্তু চলে যায়নি।তাঁকে গুপ্তচর মনে করে, অনেক সময় গুলি করে মারার চিন্তা করলেও, কেউ তাঁকে হত্যা করতে সায় দেয়নি। কখন যে মানুষটা মরে গেলো, সময় মনে নেই। তবে নিউকলোনীর পুকুরের উত্তরপূর্ব কোনায়, তাঁকে সমাহিত করার পর, কিছু মানুষ কবর কেন্দ্রীক একটা ‘মাজার’ ব্যবসা চালু করার চেষ্টা করেও সফল হয়নি। নেংটা পাগলার ইতিহাস সেখানেই শেষ হয়। আমার ছেলে বেলার লালমনিরহাটে সেই মানুষটার কথা এখনো খুব রহস্যময়তার মাঝে স্মরণ করি।

আর একটা পাগল ছিলো, বাটুল আর গুলতি দিয়ে পাখি শিকার করে, পুড়িয়ে খেতো। নির্ভূল নিশানায়, আমাদের চারপাশের নানান পাখি মারতো, এবং জবেহ করে, পুরিয়ে খেতো, আদিম মানুষের অভ্যাসের মতো।
এ নিয়ে আমার কিশোর মনের ভাবনার অন্ত ছিলো না।
এই পাখি শিকারী পাগলকেও মুক্তিযোদ্ধারা বিহারী মনে করে মেরে ফেলতে চায়। সে নাকি নির্নিমেশ নয়নে তার দিকে তাক করা বন্দুকের নলের দিকে তাকিয়ে ছিলো। এমন অকুতোভয় পাগলকে পরে আর মারা হয়নি।
সে রংপুরে চলে যায়। তাঁকে আর কখনো খুঁজে পাইনি।

মানুষ যখন নিজের স্বার্থত্যাগ করে, জীবনের অর্থনৈতিক পুরস্কার ও অর্জনকে তুচ্ছ করে, সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে সাহসী বক্তব্য দিয়ে কথা বলে যায়, তখন অন্য মানুষেরা তাঁদের বলেন “পাগল মানুষ”।
এই পাগল মানুষের লিষ্টে, আমার ও বন্ধু অবসরপ্রাপ্ত রেলওয়ে গার্ড
কাজলেরও তাই মনে হয়,
যে ডাকু মামা হলেন টপ অব দ্যা লিষ্টে।
এখন বেচে থাকলে ডাকু মামার বয়স ৭৭ হতো হয়তোবা।
চিলড্রেন পার্ক হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হয়ে রিটায়ার করেছিলেন।
ওনার বাবা রেলওয়ের একজন কেরানী ছিলেন।
আমার নানা মীর আজিজুল হক ও কেরানী ছিলেন।ডিটিএস অফিসের চীফ ক্লার্ক।
এখন কেরানী-সেক্রেটারী হয়েছে, একটু শ্রুতিমধুর আয়েসী নাম। তখনকার দিনের কর্তব্যপরায়ন এই সব মানুষেরা ঘড়ি ধরে অফিস করতেন। কাজে নিষ্ঠাবান ছিলেন। রেলের ট্রেন সব সময় মতো চলতো। ইঞ্জিন সচল ছিলো। সবাই যার যার দায়িত্ব ঠিক মতো পালন করতেন।
ডাকু মামার বাবা, কথা কম বলতেন, ডাকসাইটে একজন আপাদমস্তক ভদ্রলোক। পাকিস্তান আমলে তাঁর বাসায় একটা দুটো বিদেশী কুকুর সব সময় থাকতো। দুই ছেলে, ডাকু মামা ফিজিক্সে এমএসসি পাশ করে, চিলড্রেন পার্ক স্কুলে ঢোকার আগে হয়তো দু এক জায়গায় কাজ করেছেন শিক্ষকতার।
তারপর থিতু হলেন লালমনিরহাট।বাবু পাড়ায় থাকতেন।
ওনাদের বাসায় হারমনিয়াম বাজিয়ে গান হতো।
তুতুল রবিন ওনাদের আত্মীয়। দারুন পপুলার। এমটি হোসেন ইনিসটিটিউটে বাৎসরিক ও জাতীয় নানান অনুষ্ঠানে ওনাদের ছাড়া কিছু হচ্ছে এটা ভাবাই যেতো না। সময়ের সাথে, বিবাহ, পড়া, কর্ম উপলক্ষে মানুষের আসা যাওয়া এটা এক চিরন্তন নীতি। সবাই ছড়িয়ে যাচ্ছিলেন।বড়দের জায়গা দখল করতো পরবর্তী প্রজন্মের মানুষেরা।

১৯৭১ সবাই মিলে দেশান্তরী হলেন। যার যার গ্রামের বাড়ী চলে গেলো কেউ কেউ। ডাকু মামা
শরনার্থী শিবিরে থাকতেন, নানান কাজ করতেন, ছোটভাই গোরা বুয়েটের ছাত্র, মুক্তিযুদ্ধে গেলেন। এই ডাকু মামার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ১৯৭২ থেকে শুরু হলো। নুতন দেশ অনেক কাজ। কিন্তু উনি সারাক্ষন মেতে আছেন ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস।
ওনার শিষ্যরা ডাকুভাই বলতে অজ্ঞান।বিকেলের মাঠে প্রতিদিন উদ্ভাষিত ডাকু ভাই। সাথে ইউনুস, বড়বাসা বকুল, পিল্টু, রুমী, কমল, আরশাদ, সাবু, মিনু, মাইকেল, বকুল, কাজল, এমন অজস্র নাম, যারা গত পঞ্চাশ বছর লালমনিরহাট জেলার সমস্ত মাঠ দাপিয়ে ফুটবল খেলেছেন। নিজে খেলেছেন, রেফারী ছিলেন, টুর্ণামেন্ট প্ল্যান করা,
টাকা পয়সার যোগাড় করা, তদারকি করা,
মাঠের নানান মারপিটের সমস্যার সমাধান করা, এ যেনো ভুবন জয়ী এক কাজ।

অলস দুষ্টমি আড্ডা এসব থেকে নুতন প্রজন্মকে দুরে সরিয়ে রাখার এমন বাঁশীর যাদুকর, এখন আর খুঁজে পাওয়া দায়। একদিনের একটা গল্প বলে শেষ করি।
মটর সাইকেল এর পিছলে পড়ার দুর্ঘটনায় ডাকু মামা আহত।
আমাদের থানাপাড়ার বাড়ী কাছাকাছি।
জলদি করে খবর পেয়ে গেলাম।
দেখি উঠানের কলপাড়ে মামা গোসল করছেন। হাতের কনুই, হাঁটু সব ছিলে গেছে, রক্তাক্ত। মামা পানি দিয়ে নিঃসঙ্কোচে সব মাটি, রাস্তার ধুলা, ব্রাশ করার মতো করে গামছা দিয়ে ঘষে ধুচ্ছেন।
আমার নিজের মাথাটা ঘুরে গেলো। বললাম করেন কি?
জ্বলছে না!
ব্যথা পাচ্ছেন না?
ডাকু মামা হাসলেন। একটু তো করছে।
তাতে কি, এমন তো কতো কেটে যায় ছিলে যায়।

এমন অদ্ভূত একটা মানুষ, এনাদের পাগলামির অনেক গল্প সমাজের সবখানে ছড়িয়ে আছে।ডাকু মামার খালাতো ভাই, গিলপিন, হিডি, টিটো (পাইলট) এনারা সময় পেলে লালমনিরহাট এসে মাতিয়ে দিয়ে যেতেন। সব ভাইয়েরা বসে যখন পুরাতন দিনের গল্প ধরতেন, মনে হতো ওনাদের ছেলেবেলা কতো দুরন্ত, কতো মোহময় ছিলো।

সেই ডাকু মামা একদিন গভীর রাতে, বারডেমে ভর্তি হলেন। টিটো মামার কাছে শোনা, দুবার রক্ত বমি করে, ডাকু মামা চলে গেলেন।
কি হয়েছিলো কিছুই জানলাম না।
অংক পদার্থবিদ্যা রসায়ন এসব শিক্ষকেরা ছাত্র পড়িয়ে সারা জীবন কতো অর্থ সম্পদ গুছিয়ে রেখে যান, ডাকু মামা স্কুলের বেতনের বাইরে, প্রাইভেট টিউশন করে কখনো কিছু অর্জনের চিন্তা করেন নাই। স্কুলের শিক্ষাদান যদি পরিপূর্ন হয়, তবে ছাত্রদের কেন প্রাইভেট পরতে হবে?
এ ধরনের পরিচ্ছন্ন চিন্তার মানুষের বড়োই অভাব বর্তমান পৃথিবীতে।

ডাকু মামার লালমনিরহাটে থাকার দীর্ঘ জীবনের খেলার মাঠের অজস্র গল্পগুলো, আরশাদ খুব মজা করে বলতে পারতো।
মনে করার এই মানুষেরা আজ হারিয়ে যাচ্ছে, স্মৃতি থেকে।
যেমন মন্টু বকসী, সুবোধ সরকার ষষ্টী, মিনু, মাইকেল, সাবু, সব হৈচৈ করা বিকেলের ছায়া, এখন সীমাহীন অলসতা নিয়ে বসে থাকা এক ঝিমানো প্রজন্মের দখলে চলে যাচ্ছে।
নাম দিয়েছে কিশোর গ্যাং। এতো পুলিশ আইনের লোক তাঁদের চোখের সামনে, এ কোন প্রজন্ম রেখে যাচ্ছি আমরা?
খুবই অবাক লাগে।

 

জাকি ফারুকী/ টিনটনফলস্/ নিউজার্সি
১৯/৫/২৪

সংবাদটি শেয়ার করুন




এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা ও ছবি অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি
Design & Developed by Freelancer Zone