:: কাজী জহিরুল ইসলাম :: আমার এক বন্ধু আশরাফ আহমেদ, জাপানে থাকেন। নিশান কোম্পানির উচ্চপদে কাজ করেন। ড. ইউনূস লোভী কি-না এই বিষয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আমার পোস্ট দেখে তিনি ফোন দেন। তখন বেশ রাত, ঘুমুতে যাবো, তবুও ফোনটা ধরি। জাপানের মানুষ ড. ইউনূসকে যে কী পরিমান শ্রদ্ধা করে, সম্মান করে সেই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে এও বলেন, নিশানের সিইও দুই বছর ঘুরেও ড. ইউনূসের সঙ্গে দেখা করার শিডিউল পাননি। অবশেষে তিনি ড. ইউনূসের সঙ্গে একই প্লেনে বসার অনুমতি পান, সেখানেই ১ ঘন্টার একটা মিটিং সেরে নেন। সিইও ভদ্রলোক এই বিমান জার্নিটা করেছিলেন শুধু ড. ইউনূসের সঙ্গে দেখা করার জন্য।
কিছুদিন আগে অ্যামেরিটাস অধ্যাপক ড. মোস্তফা সারোয়ারের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। তিনি বলেন, ইউনূস সাহেব হচ্ছে উল্টোরথের মানুষ। অতিরিক্ত সততা এবং দেশপ্রেমের জন্যই আজ তার এ-অবস্থা। যখন মেধাবী লোকেরা নিরাপত্তার জন্য দেশ থেকে টাকা-পয়সা তুলে বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে, সেই সময়ে তিনি বিদেশে আয় করে সেই আয়ের টাকা দেশে নিয়ে যাচ্ছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি ড. ইউনূসের আয়ের একটা ধারণা দেন আমাকে। এক বক্তৃতার জন্য তিনি পান বাংলাদেশি টাকায় ৫০ লক্ষ থেকে ৩ কোটি টাকা, কখনো তা ১০ কোটিও ছাড়িয়ে যায়। আমি ধারণা করছি ২০০৬ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর থেকেই তার বক্তৃতা শোনার জন্য বিশ্বের মানুষদের আগ্রহ অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে।
জাতিসংঘের একজন আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা হিসেবে পৃথিবীর নানান দেশে আমি কাজ করেছি, কর্মসূত্রে ভ্রমণ করেছি পৃথিবীর বহু দেশ, এখনও করি। পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই যে দেশের মানুষের সঙ্গে আমার কখনো দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। এক সময় সাংবাদিকতা করতাম, সৃজনশীল এবং মননশীল লেখালেখি করি, আমি বিশ্বাস করি অন্য অনেকের চেয়ে আমার একটি ভিন্ন পর্যবেক্ষণাগ্রহ, কৌতুহল আর কি, এবং বলতে পারেন কিছুটা পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাও রয়েছে। সেই কৌতূহল থেকেই নানান দেশের মানুষের কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চাই। সকলেই বাংলাদেশ প্রসঙ্গে একজন মানুষের নাম বলেন, তিনি ড. ইউনূস। কেউ কেউ দ্বিতীয় আরো একটি নাম বলেন, তসলিমা নাসরিন। আমি এই দুজন মানুষের কাছে তখনই মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানাই, কারণ তাদের জন্য পৃথিবীর বহু মানুষের কাছে বাংলাদেশ বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। অনেকে বলেন, তসলিমার জন্য পৃথিবীর মানুষ বাংলাদেশকে উগ্র সাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে চিনেছে, এতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে। আমি বলি, আগে তো দেশটাকে চিনুক, তারপর নিজেদের আগ্রহেই তারা এই দেশের প্রকৃত চিত্র একদিন দেখে নেবে। এখন তথ্য এবং জ্ঞান আমাদের সকলেরই হাতের মুঠোয়। যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ আমাকে গালি দেয় আমি খুব খুশি হই। খুশি হই এজন্য যে তখন আমার কাছে প্রচুর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসে, পেইজের ফলোয়ার বাড়ে। কারণ আমার প্রতি ছুঁড়ে দেয়া বিদ্বেষ মানুষকে আমার প্রতি কৌতুহলী করে তোলে। তখন তারা আমার সম্পর্কে খোঁজ-খবর করে। যখন দেখে লোকটা তো ততটা মন্দ না, অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সত্যি কথাটা অবলীলায় বলেন, তখন তারা আমার ভক্ত হয়ে যায়। মানুষ সত্যকে একদিন আবিস্কার করেই, সত্য আসলে আগুনের মতো, লুকানো যায় না। যারা মিথ্যা বলেন, তারাও সত্যটা জানেন, জানার চেষ্টা করেন কিন্তু অনৈতিক উদ্দেশে মিথ্যাটা বলেন।
নিন্দা সম্পর্কে একটা কথা বলি। ভারতের বিখ্যাত এবং বিতর্কিত লেখক খুশবন্ত সিংয়ের কাছে গালিগালাজে পূর্ণ একটি চিঠি আসে কানাডা থেকে। খামের ওপরে লেখা ছিল, “বাস্টার্ড খুশবন্ত সিং, ইন্ডিয়া”। ঠিকানাবিহীন এই পত্রখানি ভারতের ডাকবিভাগ তার বাড়িতে ঠিকই পৌঁছে দেয়। এতে তিনি ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। বাস্টার্ড উপাধি তাকে সারা ভারতে এক এবং অদ্বিতীয় করে তোলায় তিনি আনন্দ পেয়েছেন। তার স্ত্রী চিঠিটি ছিঁড়ে পুড়িয়ে ফেলায় তিনি খুব আঘাত পেয়েছেন এবং লিখেছেন, এক মহামূল্যবান সম্পদ হারালাম। পৃথিবীর দুয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তির মতো তার দিকে কেউ জুতো ছুঁড়ে মারেনি কেন, এই আফসোস তার ছিল। পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ ইত্যাদি সম্মাননায় তিনি ততোটা আবেগানন্দে ভাসেননি। তিনি লিখেছেন তার সাংবাদিকতা, সাহিত্যকর্ম তিনটি নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত: মানুষকে আনন্দ দেওয়া, তথ্য দেওয়া এবং ক্ষেপানো। লেখকদের পরামর্শ দিয়েছেন, কখনো পাঠকের স্তরে নেমে লিখবে না। তুমি সত্য লিখবে, তোমার লেখা লিখবে। তিনি আরো বলেছেন, সত্য প্রকাশের জন্য তুমি নিগৃহীত হবে, নিগৃহীত হবার জন্য সব সময় তৈরি থাকবে। খুশবন্তের এইসব নীতির সঙ্গে আমারও ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা নীতিবোধের মিল আছে।
আসলে ড. ইউনূস প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তসলিমা এবং খুশবন্ত সিং প্রসঙ্গ এসে গেলো, মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাই। এই যে এতো এতো টাকা দিয়ে মানুষ ড. ইউনূসকে নিয়ে আসে বক্তৃতা শোনার জন্য। কী বলেন তিনি? তিনি কী বলেন তার সব না হলেও কিছু কিছু আমরা বিনা পয়সায় ইউটিউবে গিয়ে দেখতে পারি। অধিকাংশ বক্তৃতাই ইংরেজিতে, যারা ইংরেজি বোঝেন না তাদের জন্য অসুবিধাই হবে, তবে যারা ইংরেজি বোঝেন তারা অনায়াসেই জেনে নিতে পারবেন তিনি কী বলেন।
তিনি একজন ইনোভেটিভ মানুষ। প্রতিনিয়তই নতুন কিছু করার চেষ্টা করেন। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ফ্যারফ্যারা সুতির চেক কাপড় দিয়ে তৈরি পোশাককে তিনি তুলে দিয়েছিলেন শহরের অভিজাত মানুষের দেহে, রাতারাতি গ্রামীণ চেক দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পোশাক হয়ে ওঠে। গ্রামীণ চেকের ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য তিনি কাজে লাগান বিশ্বখ্যাত বাঙালি মডেল বিবি রাসেলকে।
১৯৯৩ সাল। আমাদের (বিজ্ঞান গণশিক্ষা কেন্দ্রের) বোর্ড মেম্বার ড. ইউনূস। তিনি একদিন বলেন, গ্রামীণ ব্যাংক বাংলাদেশের কৃষকের হাতে হাতে তুলে দেবে মোবাইল ফোন। মাত্রা ১০ হাজার টাকায় বিনা তারের সেল ফোন পাওয়া যাবে। তখন বাংলাদেশের মানুষ ঠিক মত জানেই না সেল ফোন কি? মাত্র মোরশেদ খানের কোম্পানি সিটিসেল ফোন বাজারে এনেছে। যার একেকটির দাম লক্ষাধিক টাকা। শুধুমাত্র অতি ধনী লোকদের জন্য তখন এই বস্তু। এর দাম কখনো ১০ হাজার কি করে হতে পারে তা আমাদের চিন্তায় আসত না। তার ভাই ড. ইব্রাহীমের একটি কথাও আমার কানে আজও বাজে। তখন মাত্র দেশে কম্পিউটার এসেছে। তিনি আমাদের বলছেন, একদিন মানুষের অফিস কনসেপ্ট বদলে যাবে। চারদেয়ালের ভেতরেই আর অফিস থাকবে না। অফিস থাকবে স্যুটকেসে। তোমার একটা কম্পিউটার থাকবে, সমুদ্র সৈকতে বসে তুমি অফিস করবে। আমার যতদূর মনে পড়ে তখনও ল্যাপটপ আসেনি, ওয়াইফাই ধারণা তো বাংলাদেশের কারো চিন্তায়ও আসার কথা নয়।
আমি দেখতাম তারা দুই ভাই নতুন নতুন আইডিয়ায় টগবগ করতেন। ইব্রাহীম সাহেব ইমপ্লিমেন্টেশনে ততোটা ভালো ছিলেন না বলে তার অনেক ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া পুরোপুরি আলোর মুখ দেখেনি। ক্ষুদ্র স্কেলে অনেক কিছুই তিনি করেছেন, একদিন তার ইনোভেটিভ ধারণাগুলো নিয়ে লিখবো। বড়ো স্কেলে সেগুলোর বাস্তবায়ন করা গেলে দেশে বিপ্লব ঘটে যেত।
ড. ইউনূস এখন যা বলেন তা হচ্ছে তিন শূন্যের গল্প। শূন্যের কি কোনো মূল্য আছে? আছে, যদি তা দিয়ে নেতিবাচকতাকে এলিমিনেট করা যায়। সেটিই করতে চান তিন শূন্যের প্রবক্তা ড. ইউনূস। কী সেই তিন শূন্য?
বেকারত্বকে শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। অর্থাৎ পৃথিবীতে কর্মক্ষম কোনো মানুষ বেকার থাকবে না। এটা যদি নিশ্চিত করা যায় তাহলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নিশ্চিত হবে, স্বচ্ছলতা আসবে, দারিদ্র জাদুঘরে চলে যাবে। এরপরের শূন্যটি হচ্ছে সম্পদ পুঞ্জিভূতকরণ। ধনী মানুষেরা ক্রমাগত ধনী হতে পারবে না। সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করতে হবে। কিছুদিন আগে তার এক বক্তৃতায় শুনলাম পৃথিবীর অর্ধেক সম্পদ নাকি এখন চারজন ব্যক্তির হাতে। তিনি এই ব্যবস্থা ভেঙে দিতে চান। সেটা কীভাবে সম্ভব? তখনই আমাদের জানতে হয় তারই আরেক ইনোভেশন সোশ্যাল বিজনেস। “কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবলিটি” বলে একটা ধারণা উন্নত বিশ্বে বহুদিন থেকেই চালু আছে। বড়ো বড়ো কোম্পানিগুলো তাদের মুনাফার একটি অংশ সেবামূলক কাজে ব্যয় করে, এটিই কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবলিটি। এই সেবামূলক কাজে ব্যায়ের শেয়ার বাড়িয়ে “ওয়েলথ কন্সেন্ট্রেশন” থামানো যেতে পারে। জাতিসংঘে যদি একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়, একটি নির্দিষ্ট শতাংশ লভ্যাংশ সেবামূলক কাজে ব্যয় করতে হবে এবং এই মর্মে যদি সদস্য রাষ্ট্রগুলো আইন করে তাহলে আস্তে আস্তে এই কাঙ্খিত শূন্যের দিকে এগুতে পারবে পৃথিবী। আরো অনেক উপায় আছে, শ্রমিকদের লভ্যাংশ দেয়া ইত্যাদি বহুকিছু।
তৃতীয় শূন্যটি হচ্ছে গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণতা। শুধু সম্পদ উৎপাদন করলেই হবে না আমাদের এই পৃথিবীকেও বাঁচাতে হবে। পৃথিবী যদি ধীরে ধীরে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে তাহলে কোনো সম্পদই আর কাজে লাগবে না। তাই গ্লোবাল ওয়ার্মিংকে শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। কার্বন নিঃসরণ বন্ধ করতে হবে। এটি একটি অসম্ভব চিন্তা মনে হলেও, সেদিন এক খবরে দেখলাম ২০৫০ সালের মধ্যে ডেনমার্ক কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনবে।
এসব জানার পরে কি বলতে ইচ্ছে করছে না,
ইউনূসের তিন শূন্য
ভালোবাসার পৃথিবীকে রাখবে অক্ষুন্ন।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩
(লেখাটি কাজী জহিরুল ইসলাম-এর ফেসবুক থেকে নেয়া)