১৭, লালমনিরহাট-০২ (কালীগঞ্জ-আদিতমারী) আসনের সংসদ সদস্য ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ, তাঁর পুত্র, ভাই ও প্রয়াত বাবার কাছে প্রায় ৯লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল পাওনা নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানী লিমিটেড (নেসকো)র। চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত এসব বকেয়া জমেছে। মাসের পর মাস বিল পরিশোধ না করা হলেও পাওনা আদায়ে উদ্যোগী হচ্ছে না নেসকো।
নেসকোর রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী মোখলেসুর রহমান মন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের লোকজনের কাছে বিদ্যুৎ বিল বকেয়া পড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, যদি বিদ্যুৎ–সংযোগগুলো বকেয়া বিল থাকার পরও চলমান থাকে এবং নিয়মিত বিল করা হয়, তাহলে বুঝতে হবে এসব বিদ্যুৎ–সংযোগের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি।
অথচ ২০১৮ সালের বিদ্যুৎ আইনের ১৮ ধারায় এমন ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্নের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ওই ধারায় বলা আছে, কোনো গ্রাহক বিদ্যুৎ বিল পরিশোধে ব্যর্থ হলে অথবা কোনো ব্যক্তি অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে, নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণ করে ওই গ্রাহকের বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা যাবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নেসকোর একাধিক কর্মকর্তা বলেন, জুলাই মাসের বিল আগস্ট মাসের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিশোধ করার নিয়ম। এ নিয়মের ব্যত্যয় হলে সেপ্টেম্বর মাসের যেকোনো সময় ওই বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারবে নেসকো।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ, তাঁর পুত্র রাকিবুজ্জামান আহমেদ, সৎভাই শামসুজ্জামান এবং প্রয়াত বাবা ও সাবেক সংসদ সদস্য করিম উদ্দিন আহমেদের গ্রাহক নম্বর ও মিটার নম্বর আছে। নেসকোর ওয়েবসাইটে (postpaid.nesco.gov.bd–এ ঢুকে imput consumer number দিয়ে অপরিশোধিত বিল অংশে) গিয়ে এই চারজনের বিদ্যুতের বকেয়া বিলসংক্রান্ত তথ্য–উপাত্ত পাওয়া যায়।
নেসকোতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর নামে থাকা মিটারটি তাঁর বাসভবন লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের তুষভান্ডার ইউনিয়নের কাশীরাম গ্রামে। আগের কয়েক মাসের বকেয়াসহ ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ওই মিটারের বিপরীতে বকেয়া দাঁড়িয়েছে ১১হাজার ৬শত ২০টাকা। মন্ত্রীর নামে আরেকটি মিটার আছে।
কাশীরাম গ্রামে ওই মিটারের বিপরীতে বকেয়া বিলের পরিমাণ ৬১হাজার ৩শত ৪৪টাকা। এর মধ্যে ২০২২ সালের মার্চ মাসের বিল ১৭হাজার ২শত ৩৬টাকা, বিলম্ব ফি ৮শত ৬২টাকা; চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির বিল ৯হাজার ৩শত ৯০টাকা, বিলম্ব ফি ৪শত ৭০টাকা; মার্চের বিল ৯হাজার ৮শত ৫০টাকা, বিলম্ব ফি ৪শত ৯৩টাকা; এপ্রিলের বিল ৯হাজার ৮শত ৫০টাকা, বিলম্ব ফি ৪শত ৯৩টাকা এবং মে মাসের বিল ৯হাজার ৬শত ৪০টাকা ও বিলম্ব ফি ৪শত ৮২টাকা। মন্ত্রীর নামে আবাসিক ও সেচ মিটারের বিপরীতে নেসকোর মোট বকেয়া বিলের পরিমাণ ৭২হাজার ৯শত ৬৪টাকা।
মন্ত্রীর পুত্র ও লালমনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিবুজ্জামান আহমেদের কাছে নেসকোর বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের পরিমাণ ৭৯হাজার ৯শত ৯৫টাকা। রাকিবুজ্জামানের নামে থাকা মিটারের বিপরীতে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৯হাজার ৯শত ৯৫টাকা।
এ বিষয়ে রাকিবুজ্জামান আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের বিদ্যুৎ বিলের বিষয়টি ব্যবস্থাপক দেখাশোনা করেন। বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের টাকা দেওয়ার কথা। সেটা দেওয়া হয়েছে কি না তিনি ভালো বলতে পারবেন।
সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ বিল বকেয়া পড়েছে মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের সৎভাই শামসুজ্জামান আহমেদের নামে। তাঁর নামে থাকা মিটারটির বিপরীতে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আগের কয়েক মাসসহ মোট বকেয়া ছিল ৫৯হাজার ৭শত ৬টাকা। চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬লাখ ২০হাজার ১শত ৩৩টাকা। তাঁর নামে নেসকোর আরেকটি মিটার আছে। সেচ সংযোগের জন্য নেওয়া ওই মিটারের বিপরীতে বকেয়া বিলের পরিমাণ ১লাখ ৫হাজার ১১টাকা। বিল না পেয়ে মিটারটির সংযোগ অস্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন করা আছে। কিন্তু বকেয়া আদায় করা হয়নি। শামসুজ্জামানের কাছ থেকে দুটি মিটারের বিপরীতে ৭লাখ ২৫হাজার ১শত ৪৪টাকা বকেয়া আদায়ের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই নেসকোর।
এ বিষয়ে শামসুজ্জামান আহমেদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
৩২বছর আগে মারা যান সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর বাবা সাবেক সংসদ সদস্য করিম উদ্দিন আহমেদ। তাঁর নামে এখনো একটি বৈদ্যুতিক মিটার সচল আছে। মিটারটির বিপরীতে মোট বকেয়া বিলের পরিমাণ ১৮হাজার ৫শত ৭৭টাকা।
মন্ত্রীসহ চারজনের নামে থাকা বকেয়া বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করা হয়নি বলে গণমাধ্যমকে নেসকোর কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিশ্চিত করেছেন।
নেসকোর রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী মোখলেসুর রহমান বলেন, বকেয়া পরিশোধ করতে মৌখিকভাবে বলা হয়েছে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে এখনো পর্যন্ত কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বকেয়া বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করার মতো সামর্থ্য ওই সব গ্রাহকের আছে, তাঁরা সময় সুযোগমতো পরিশোধ করবেন।
লালমনিরহাট সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি কাশেম আলী বলেন, সাধারণ গ্রাহকদের বেলায় দুই–তিন মাসের বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের জন্য সংযোগ বিচ্ছিন্ন করাসহ নানা কিছু করে নেসকো। মন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের কাছে তিন বছর বিদ্যুৎ বিল বকেয়া থাকার পরও নেসকোর কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার বিষয়টি কাম্য নয়।
প্রসঙ্গত, মন্ত্রীর পুত্র রাকিবুজ্জামান আহমেদের ডাকে দেখা করতে না যাওয়ায় ২৯ আগস্ট দুপুরে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জে উপজেলা নেসকোর কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী রকি চন্দ্র রায় (৪০) সহকয়েকজনকে লাঞ্ছিত করা হয়। কার্যালয়ে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। হামলায় নেতৃত্ব দেন কালীগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শরিফুল ইসলাম। পরে লাঞ্ছিত প্রকৌশলীকে সাময়িক বরখাস্ত করে নেসকো।