শিরোনাম :
সাপ্তাহিক আলোর মনি পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে আপনাকে স্বাগতম। # সারাবিশ্বের সর্বশেষ সংবাদ পড়তে আমাদের সঙ্গেই থাকুন। -ধন্যবাদ।
শিরোনাম :
লালমনিরহাটে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত পাটগ্রামে শহীদ জিয়া স্মৃতি গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্ণামেন্ট অনুষ্ঠিত গণতন্ত্র আমাদের হাতের নাগালে নাই-লালমনিরহাটে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায় লালমনিরহাটে বিনামূল্যে চক্ষু চিকিৎসা ও ঔষধ সেবা অর্ধেক মূল্যে হত দরিদ্রদের ছানি অপারেশন অরবিট চক্ষু হাসপাতালে লালমনিরহাটে শীতের হরেক রকমের পিঠার দোকানের পসরা নিয়ে বসছেন বিক্রেতারা বিএনপির কর্মী সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত বাবা-মাকে একটা বাড়ি করে দেওয়ার স্বপ্ন যেন চিরতরে হারিয়ে গেলো লালমনিরহাটের শহীদ শাহিনুর আলমের বিএনপির কর্মী সভা অনুষ্ঠিত যতদিন নির্বাচন হবে না, ততদিন স্বাভাবিক অবস্থায় দেশে ফিরে আসবেনা-অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু আলু চাষ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন লালমনিরহাটের কৃষকেরা
প্রকৃতি ও কিছু কথা

প্রকৃতি ও কিছু কথা

খুজিস্তা নূর-ই নাহারিন:

আমার জন্ম জামালপুরের বিখ্যাত চানবানু খালার হাতে আমলাপাড়ায় আমাদের বাসায়।

 

ছোট বেলা থেকেই বার বার প্রেমে পরি।আমার প্রথম প্রেম মা’য়ের ফুলের বাগান। সারাদিন এ ফুল থেকে ও’ ফুলে গন্ধ শুঁকি হাত বাড়িয়ে আদর করি কিন্তু কখনো ছিঁড়ি না। জুঁই, চাপা, বেলী, গন্ধরাজ, টগর, গোলাপ, জবা, কামেনী, গেন্দা, কসমস, বোগেনভেলিয়া, মানি প্ল্যান্ট, হরেক রঙের পাতাবাহার, নাম অজানা আরও কতো শত ফুলের গাছ। আম্মা বলেছিলেন, ফুল ছিঁড়লে গাছ কষ্ট পাবে কাঁদবে। ফুল বাগানে আমার সাথে ভিন্ন ভিন্ন রঙের প্রজাপতি আর পাখীরাও থাকে, শান্ত স্বভাবের আমি ওদেরকেও ডিস্টার্ব করি না আর ছোট্ট আর নির্বিবাদী বলে ওরাও আমায় ভয় পায় না কিংবা পাত্তা দেয় না।  

 

একটু বড় হওয়ার পর বাসার পেছনের আব্বার ফলের বাগান আমার প্রিয় হয়ে উঠে। গাছের মগ ডালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুয়ে থেকে গোল গোল লাল পিঁপড়া দেখি, গাছে জড়ানো পরগাছা দেখি, পাখী দেখি, পাতার ফাঁকে গলে পরা সূর্যের আলোর সাথে খেলা করি । আমাদের বাসায় থাকা টুলী, জবেদা লেবু আর ফলের বাগানে আমায় খুঁজতে আসে, ডাকে। আমি চুপ চাপ শুয়ে থাকি, নড়ি না। চিৎকার করে ডেকে ডেকে ওরা হয়রান হয়, আমার মা’ও একসময় খুঁজতে বের হয়, আমার আনন্দ লাগে। চুপিসারে গাছ থেকে নেমে আসি। প্রতিদিন গাছে উঠে লুকিয়ে থাকা আমার প্রিয় খেলা কিন্তু যেদিন সুপারি গাছে উঠলাম, আম্মা দেখে ফেললেন, গাছ থেকে নামিয়ে নিয়ে গালে ঠাস ঠাস চড়, ”মেয়ে মানুষ গাছে চড়ে কি করে, এই কথা সবাই জেনে গেলে তোকে বিয়ে করবে কেউ?’’

 

আম্মা গাছ থেকে নামিয়ে এনে কালো শরীরটাতে হলুদ মেখে গোসল করায়, ভবিষ্যতের জন্য রূপবতী পাত্রী তৈরী করতে চায়। চুপচাপ আমি সুযোগ খুঁজি আবারও আম-জাম-লিচু গাছের মগ ডালে উঠার, গাছের পাতার ফাঁকে বৃষ্টি আর আলোর ঝলকানি দেখার, ওদের সাথে খেলা করার।

 

দুপুর বেলা আম্মা ঘুমানো মাত্রই বাইরে যেয়ে ছেলে বন্ধুদের সাথে ডাংগুলি খেলি, সিগারেটের প্যাকেট আর কলশী ভাঙ্গা মাটির চাড়া দিয়ে এক্কা দোক্কা খেলি। সারাদিন রোঁদে পুড়ে ছেলে বন্ধুদের সাথে দৌড়াদৌড়ি করি, সিগারেটের প্যাকেট টুকাই।

 

আব্বা চেইন স্মোকার ছিলেন, আমার ইমিডিয়েট ৮বছরের বড় ভাই চুরি করে  আব্বার সিগারেট খেত। আব্বার ফেলে দেওয়া সিগারেটও খেত। দৃশ্যটা দেখে এতোটাই ভালো লাগলো আমার, আমি আম্মার কাছে বিচার দিয়ে ওকে মার খাওয়ালাম তারপর আমি নিজেই আব্বার পেছনে যেয়ে ভাইয়ের অনুকরণে ফেলে দেওয়া সিগারেটের টুকরায়  সুখ টান দিতে শুরু করলাম। মাঝে মাঝে আব্বার সিগারেট প্যাকেট থেকে লুকিয়ে সিগারেট নিয়ে আয়নার সামনে নাক দিয়ে ধুঁয়া ছাড়া প্র্যাকটিস করতাম। নিজেকে অনেক কেপাবল আর দক্ষ মনে হত। ফ্রক পরা আমাকে আয়নায় সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়া তৃপ্ত মুখে পৃথিবীর সবচেয়ে সুশ্রী আর সুখী মনে হত।

 

শেরপুরের চর পক্ষীমারী দিকপাড়া আমার দাদার বাড়ি। আব্বার তিনমাস বয়সে আমার প্রায় কিশোরী দাদীকে ফেলে কলেরা আক্রান্ত দাদাকে আল্লাহ্‌ আপন করে নিয়েছেন । আমার আব্বার দাদা ছিলেন সেই সময়ের নামকরা কবিরাজ কিন্তু বিশাল ধানী জমির অধিকারী। পরবর্তীতে বিধবা ছেলের বউ অর্থাৎ আমার দাদীকে কবিরাজি বিদ্যা শিখান, যাতে করে তিন সন্তানকে মানুষ করার পাশাপাশি অন্য মানুষদের সেবার মাধ্যমে সুন্দর ভাবে জীবনটা কাটাতে পারেন তিনি। দাদার বাড়িতে মানুষের আনাগোনা, ভীষণ ভিড়, সারাদিন দাদীর কাছে দূর দূরান্ত থেকে রোগী আসতো ওষুধ নিতে। দাদী বনে জঙ্গলে ঘুরে লতা-পাতা, গুল্ম, শিকড়-বাকড় খুঁজে খুঁজে ওষুধ বানিয়ে দিতেন কিন্তু কখনোও কোন পয়সা নিতেন না। তাঁর শ্বশুরের বারণ, মানুষের সেবায় পয়সা নিতে হয় না।

 

আমার ছোট বেলায় ওই গ্রামে কারেন্ট নেই, হ্যারিকেন আর হ্যাজাকের আলো, কুপিও জ্বালিয়ে রান্না করে। কারো হাতে তাল পাখা আবার কারো হাতে সূতায় খচিত নকশী পাখায় কারুকার্য। জেঠীমা’র  দেওয়াল জুড়ে অনেক গুলো হাতে সেলাই করা কাঁচে বাঁধানো কাঠের ফ্রেম। একটিতে লেখা, “জাতের মেয়ে কালোও ভালো, নদীর জল ঘুলা ভালো।” এটা বার বার পড়তাম আর ভাবতাম, আমি কালো, কিন্তু তাতে কি ! আরেকটিতে লেখা, “যাও পাখী বল তাঁরে, সে যেন ভুলে না মোরে।”

 

গ্রামে সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে আমি নদীর ধারে যেতাম, শামুক কুড়াতাম, ক্ষেত থেকে তরমুজ উঠিয়ে বড় গাছের সাথে বারি দিয়ে ভেঙ্গে তরমুজ খেতাম, পাঁট ক্ষেতে গ্রামের বন্ধুদের সাথে লুকোচুরি খেলতাম। একদিন তীরে বেঁধে রাখা নৌকার বাঁধন খুলে ছোট্ট লাঠি দিয়ে একা একাই বাইতে শুরু করলাম। নৌকা যত মাঝ পথে যায় নদীতে ভাসে আমার ততো আনন্দ লাগে। কে যেন দেখে ফেলে চিৎকার করে উঠলো, তাড়াতাড়ি সাঁতরে যেয়ে নৌকা ঘাটে ভিরালো, আমার ওই আনন্দের ওইখানেই পরিসমাপ্তি।

 

কাঁক ডাকা ভোরে গ্রামের বউরা কয়লার আগুন আর তামাক দিয়ে হুক্কা সাঁজায়। ক্ষেতে যাওয়ার আগে সবাই একসাথে বসে গুঁড় গুঁড় শব্দে হুক্কায়  টান দেয় । হুক্কার গন্ধ আর গুঁড় গুঁড় ডাক আমায় মাতাল করে, আমি অপেক্ষায় থাকি, সবাই চলে যাওয়ার পর আমিও হুঁকায় টান দেই, ধুঁয়া ছাড়ি। মনে প্রশান্তি লাগে, এক ধরণের সুখ কাজ করে । জ্যাঠি মা’ র কাছে ধরা পরে গেলাম একদিন ।

 

গ্রাম থেকে নৌকায় জামালপুর ফেরার পথে মায়ের আঁচলের তলায় মুখ লুকাই, কাঁদি। গ্রামের সবার জন্য মন খারাপ হয়।

 

আমার মা’য়ের সাত ভাই বোনের সংসারে সবাই ভীষণ উচ্চ শিক্ষিত, ওদের ভাব ভঙ্গী কথা বলা অনেক বেশী পরিশীলিত, সুন্দর, মাপা-মাপা। আমার মায়ের মামারাও অনেক শিক্ষিত। আমার দাদার বাড়ির থেকে নানার বাড়ি অনেক বেশী আধুনিক, শিক্ষিত এবং কালচারড, কিন্তু আমার সম্পূর্ণ অশিক্ষিত মূর্খ দাদীর জন্যই কেবল মন কেমন করে, পুড়ে। দাদীকে ছেড়ে আসার সময় কাঁদি, দাদী আমাকে ছেড়ে যাওয়ার সময়ও দাদীর গলা ধরে কাঁদি, আঁচল টেনে ধরে রাখি।

 

গ্রামের বাড়িতে দাদী মারা যাওয়ার পর মাত্র বার কয়েক গিয়েছি, জেঠী আর জ্যাঠা মারা যাওয়ার পর ওই টানটা অনুভব করিনি আর। আবেগের পুরো সুতোটাই হয়তো ছিঁড়ে গেছে তাই। আব্বার টুইন বোন বাচ্চা হওয়ার সময় মারা গিয়েছিলেন আমার জন্মের অনেক বছর আগেই।

 

আমি প্রকৃতি কন্যা, পূর্ব পুরুষরা কৃষক ছিলেন। চরের বালি সরিয়ে সরিয়ে সোনা ফলাতেন। আমার পুরো শরীর জুড়েই কৃষকের রক্ত, চরের শক্তিশালী সুঠাম দেহী পরিশ্রমী মানুষের দ্রোহ আর সংগ্রামের ইতিহাস, সারাজীবন একা কাটানো আমার দাদীর অভিমানী, রজ্জু, রুদ্ধ আবেগ।

 

আমার মাটির সুদা গন্ধ ভালো লাগে, পাট ক্ষেত আর ধান ক্ষেতে বয়ে যাওয়া ঢেও খেলানো বাতাস দেখতে ভালো লাগে। নদী আর বিস্তীর্ণ জুড়ে থাকা খোলা নীল আকাশে ভেসে থাকা সাদা মেঘের ভেলা দেখতে ভালো লাগে, ঘন জঙ্গলে ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে ভালো লাগে, খোলা হাওয়ায় নদীর জলে সাঁতরাতে ভালো লাগে।

 

আমার বিয়ের পর যখন চট্টগ্রামের, রাউজানের কদলপুরের বাড়িটাতে গেলাম, আমার দাদীর কথা মনে হল। আমার শাশুড়ীদের (স্বামীর চাচীরাসহ) আমার মা’নয়, দাদী মনে হয়। কারণ দাদীর সাথেই বেশী মিল ওনাদের। আমি ওনাদের ভীষণ পছন্দ করি, উনারাও আমাকে অনেক আদর করেন। বাড়িতে ধানের গোলা, খড়, কাঁচা ফসলের গন্ধ, গরুর গোয়াল সবকিছুই আপন আর পরিচিত মনে হয়। অবসর সময়ে বাড়ির মেয়েদের সাথে গল্প করি, অল্প বয়সীদের সাথে খেলি, ক্ষেতের আল বেয়ে হাঁটি। ভীষণ ভালো লাগে আমার, কোথা দিয়ে সময় কেটে যায় হুস থাকে না।

 

চাঁটগাঁ শহরে থাকা টিংকুর ভাবী আমায় একদিন জিজ্ঞেস করলেন, “একটা অজ পাড়া গায়ে এতো অশিক্ষিত মানুষের মাঝে  কি করে যেয়ে থাকো তুমি?” তখন সম্ভবত ফ্যান আর লাইটও নেই গ্রামের বাড়িটাতে। আমার অবাক হওয়ার পালা, “মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক হয় হৃদয়ের, ধন-সম্পদ, শিক্ষা আর সুযোগ-সুবিধায় কি আসে যায় ?”

লেখক : সম্পাদক, পূর্বপশ্চিম বিডি ডট নিউজ।

সংবাদটি শেয়ার করুন




এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা ও ছবি অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি
Design & Developed by Freelancer Zone